- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
পর্ব
১: "ভালোবাসার আগে বৃষ্টি পড়ে"
"ভালোবাসা সব সময় শব্দে প্রকাশ পায় না। কিছু ভালোবাসা নিঃশব্দে বৃষ্টির মতো পড়ে, কেউ ভিজে যায়, কেউ টেরই পায় না।"
ঢাকার অগোছালো এক বর্ষার দিন।
বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ, জানালার কাচে টুপটাপ বৃষ্টির
শব্দ, আর একটা বাড়ির
ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা এক অচেনা
মেয়ে—আরিবা।
গায়ের ওড়নাটা হালকা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, সে
টেরও পায়নি। চোখ দুটো ফাঁকা,
কোথাও তাকিয়ে নেই। যেন বাইরের
বৃষ্টি নয়, তার ভিতরেই
এক বর্ষা নেমে এসেছে।
আরিবা—২৬ বছরের একজন
ইংরেজি শিক্ষক, মেধাবী, শান্ত স্বভাবের, স্বপ্নে ভরা একটা মেয়ে।
কিন্তু তার চোখে আজ
স্বপ্ন নেই, আছে ক্লান্তি।
বিগত এক বছরের ভাঙা
আক্দ, পরিবারে অশান্তি, সমাজের কটূ কথা—সবকিছু
মিলিয়ে সে যেন নিজেকেই
ভুলে গেছে।
এমন সময় দরজায়
টোকা।
—"আপু, ছাদে একা
বসে আছেন কেন? ভিজে
যাবেন তো।"
গলায় ভদ্রতা, চোখে
কিছুটা উদ্বেগ। নাম তার রায়ান—আরিবার খালাতো ভাই, সদ্য ঢাকা
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। বয়সে ছোট, কিন্তু
চোখে যেন অন্যরকম একটা
পরিণত ঝলক।
আরিবা হালকা হাসলো, "ভিজলে অসুখ হবে না
রায়ান, বরং মনটা একটু
হালকা হবে।"
রায়ান আর কিছু বলল
না। তার চোখে কিছু
একটা খেলে গেল—হয়তো
মায়া, হয়তো কিছু না
বলা আকর্ষণ।
পরবর্তী দিন
ছাদে আরিবার পাশে
চুপচাপ বসে আছে রায়ান।
—"তুমি এখনো কষ্ট
পাও, না? ওই ছেলেটার
জন্য?"
—"না, কষ্ট না। শুধু
মাঝে মাঝে নিজেকে দোষী
মনে হয়। হয়তো আমি
যথেষ্ট ছিলাম না।"
—"কেউ কারো জন্য যথেষ্ট
হয় না আপু। যারা
থাকতে চায়, তারাই যথেষ্ট
করে তোলে।"
আরিবা তাকাল রায়ানের দিকে। এত পরিণত কথা,
এই ছেলেটা সত্যিই বড় হয়ে গেছে।
কিছু কিছু কথা
মানুষকে খুব কাছের করে
তোলে। সেই সন্ধ্যার পর
থেকে রায়ান আর আরিবার মধ্যে
এক নীরব বোঝাপড়া তৈরি
হলো। তেমন কিছু বলা
হয় না, কিন্তু একসাথে
বসে থাকলেই যেন মনটা শান্ত
হয়ে যায়।
দুই মাস পর
রায়ান প্রায়ই আরিবার পাশে থাকে, বাসার
বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে।
আরিবার মা-মামারা প্রশংসা
করেন, "রায়ান কত ভদ্র, সবসময়
আরিবার পাশে থাকে।"
কিন্তু এই পাশে থাকাটা
কি নিছক ভালোবাসার আত্মীয়তা?
নাকি এর মাঝে অন্য
কিছু গাঁথা আছে?
একদিন ছাদের কোণায় বসে আরিবা বলল:
—"তুমি এত সময়
দাও কেন রায়ান? পড়াশোনা,
বন্ধু-বান্ধব, কিছুই কি মিস করো
না?"
রায়ান মাথা নিচু করে
হাসলো, "যার পাশে থাকতে
চাই, তার জন্য কিছু
মিস করা লাগে না।"
আরিবার বুকটা ধক করে উঠল।
চোখে পানি চলে এলো,
সে কিছু বলার আগেই
রায়ান বলল,
—"আপু, তুমি কেঁদো
না। আমি যদি পারি,
তোমার জীবনের বৃষ্টিকে রোদ করবো।"
আরিবা বুঝে উঠতে পারল
না—এই কথাগুলো কি
ভাইয়ের মতো যত্ন? নাকি
তার মধ্যে অন্যকিছু?
হঠাৎ রায়ানকে আর
দেখা গেল না। ফোন
বন্ধ, কোথাও খোঁজ নেই। তিনদিন
পর জানা গেল—রায়ান
কুমিল্লায় মামার বাসায় চলে গেছে, কোনো
কারণ ছাড়াই।
আরিবার মনটা অস্থির হয়ে
উঠল। একটা অদ্ভুত শুন্যতা
ঘিরে ধরল তাকে।
চতুর্থ দিনে এক চিঠি
পৌঁছালো।
"আরিবা আপু,
আমি জানি তুমি ভাবছো
কেন চলে এলাম হঠাৎ
করে। হয়তো তুমি এটাকে
গুরুত্ব না-ও দিতে
পারো।
কিন্তু আমি বুঝে গেছি—তোমার জীবনে আমার অবস্থান নিয়ে
তুমি দ্বিধায় আছো।
আর আমি চাই না,
আমার উপস্থিতি তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলে।
আমি সত্যিই...
...তোমার থেকে দূরে গিয়েও
যেন আরো কাছে আসতে
চাই।
তোমার রায়ান।"
চিঠির শেষ লাইনে একটা কালি ছোপ পড়েছে—মনে হলো কেউ চোখের পানি দিয়ে মুছে দিয়েছে।
আরিবার ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি।
কিন্তু তার চোখ বলছে—এই দূরত্ব, এই
নীরবতা... কষ্ট দিচ্ছে।
পর্ব ২:
"চিঠির উত্তর
দিতে গিয়ে…"
"কিছু দূরত্ব
প্রয়োজন… কারো মনের ভেতর ঢুকতে। কিন্তু সেই দূরত্বই যদি চিরস্থায়ী হয়ে যায়?"
রায়ানের চিঠির
পর
দিনগুলো থমকে
গেলো।
আরিবা
প্রতি
সন্ধ্যায় ছাদে
ওঠে,
রায়ানের রেখে
যাওয়া
ছোট
ছোট
জিনিসগুলো খুঁজে
ফেরে।
একটা
চায়ের
কাপ,
যেটাতে
ও
দু’জনে শেষবার বৃষ্টি
ভেজা
চা
খেয়েছিল… একটা
বই,
যেটা
রায়ান
পড়তে
দিয়েছিল—“A Thousand Splendid Suns”।
রায়ানের চিঠিটা
সে
কয়েকবার পড়েছে…
প্রতিবার পড়ার
পরই
সে
ভেবে
গেছে—একটা উত্তর দেওয়া
দরকার।
কিন্তু
কী
লিখবে?
ভালোবাসার ভাষা
তার
জানা
নেই।
আর
মায়ার
ভাষা?
সেটাও
কি
সবসময়
বোঝা
যায়?
এক
রাতে
বিছানায় শুয়ে
শুয়ে
সে
কলম
তুলে
নিলো।
"রায়ান,
তোমার
চিঠির
প্রতিটি শব্দ
যেন
আমার
ভিতরে
একেকটা
ঢেউ
তুলেছে।
জানি
না
আমি
সেই
উত্তর
দিতে
পারবো
কিনা,
যেটা
তুমি
আশা
করো।
তুমি
বলেছিলে—তোমার
উপস্থিতি আমাকে
অস্বস্তিতে ফেলতে
পারে।
আমি
বলি—তোমার অনুপস্থিতিই আমাকে
অস্থির
করে
তোলে।
আমি
ভয়
পাই
রায়ান।
তুমি
আমার
জীবনে
একমাত্র এমন
কেউ,
যাকে
হারানোর ভয়
পাই।
তুমি
যখন
পাশে
থাকো,
মনে
হয়
সব
ঠিক
হয়ে
যাবে।
কিন্তু…
আমি
কি
সত্যিই
নতুন
করে
বিশ্বাস করতে
পারবো?
তুমি
কি
আমার
অতীতের
ছায়াগুলোকে মুছে
দিতে
পারবে,
না
তার
মধ্যেই
হারিয়ে
যাবে?"
—আরিবা
চিঠিটা
সে
ঠিক
পাঠাল
না।
ভাঁজ
করে
রাখল
ডায়েরির ভেতর।
নিজেকে
বারবার
বোঝাতে
লাগলো,
“না,
এখন
না।
এখনো
সময়
হয়নি।”
এর মধ্যে গল্পে ঢুকে পড়ে আরেক চরিত্র — ফারিস।
ফারিস—আরিবার ছোটবেলার বন্ধু,
বিদেশ
থেকে
সদ্য
ফিরে
এসেছে।
এখন
একজন
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, চটপটে,
স্মার্ট আর
দৃঢ়চেতা।
আরিবার
মাকে
সে
ছোটবেলা থেকেই
“খালাম্মা” বলে ডাকে,
আর
মা-ও তাকে খুব
স্নেহ
করেন।
এক
সন্ধ্যায় খালাম্মা বললেন,
—"ফারিস
আজ
আসবে।
কতদিন
পর
আসছে,
তোদের
ছোটবেলার বন্ধু,
একসাথে
বসে
গল্প
করিস।"
আরিবার
মন
খারাপ
ছিল,
তাই
সে
কিছু
বলল
না।
কিন্তু
মনে
মনে
জানে,
ফারিস
মানে
অতীতের
আরেকটা
অধ্যায়,
যেটা
সে
পেছনে
ফেলেছে।
ফারিস
এল,
আর
সবকিছু
বদলে
গেল।
সে
ঢুকেই
বলল,
—"এই
তো
আমাদের
গম্ভীর
ম্যাডাম! কেমন
আছো
আরিবা?"
আরিবার
ঠোঁটে
কৃত্রিম হাসি,
—"ভালো।
তুমি
কেমন?"
—"আমি? এখনো আগের
মতোই…
শুধু
একটাই
পার্থক্য, এখন
আর
চোখে
তোমাকে
দেখে
ঘাবরাই
না!"
আরিবার
মুখ
গম্ভীর
হয়ে
গেল।
ফারিসের চাওয়াটা সে
চিরকালই বুঝেছে। কিন্তু
সে
কখনোই
সাড়া
দেয়নি।
পরের কয়েকদিন…
ফারিস প্রতিদিন বাসায়
আসে,
নানা
অজুহাতে গল্প
করে,
খালাম্মার মন
জয়
করে
নিচ্ছে।
আরিবার
মধ্যে
একটা
অস্বস্তি কাজ
করে।
সে
বুঝতে
পারছে,
রায়ান
আর
ফারিস—এই দুই মানুষ
তার
জীবনে
এক
অদ্ভুত
টান
তৈরি
করেছে।
রায়ান
দূরে
গিয়েও
তার
হৃদয়ের
খুব
কাছে।
আর
ফারিস
খুব
কাছে
থেকেও
যেন
অনেক
দূরে।
এক
সন্ধ্যায় ফারিস
বলল,
—"আরিবা,
এবার
আর
না।
এবার
খালাম্মার মুখের
দিকে
চেয়ে
হলেও,
আমার
কথাটা
ভাবো।"
—"ফারিস, আমি কারো
কাছে
নিজেকে
প্রমাণ
করতে
চাই
না।"
—"তাহলে কাকে প্রমাণ
করতে
চাই?
কাউকে
তো
করছো—যে প্রতিদিন তোমার
ছাদের
প্রতিটা কোণ
মনে
রাখে,
কিন্তু
তার
নাম
মুখে
আনো
না।"
আরিবার
মুখ
ফ্যাকাশে।
—"তুমি
কি
রায়ানের কথা
বলছো?"
—"হুম।
ওকে
আমি
চিনতাম। আমার
ছোট
ভাইয়ের
মতো
ছিল।
ওর
চিঠি
আমি
দেখেছি,
তোমার
ডায়েরির ভাঁজে…"
আরিবার
শ্বাস
আটকে
এল।
—"তুমি
কী
বলছো
ফারিস?"
—"তুমি
যাকে
ভালোবাসো, তাকে
আটকে
রেখেছো
নিজের
দ্বিধায়। আর
আমি…
আমি
শুধু
তোমার
পাশে
থাকতে
চেয়েছিলাম। কিন্তু
এখন
বুঝি,
ভালোবাসা জোর
করে
হয়
না।"
ফারিস
চলে
গেল।
আরিবা
ছুটে
গিয়ে
ডায়েরিটা খুলল—চিঠি নেই।
চিঠি
কেউ
নিয়ে
গেছে…
রায়ান?
ফারিস চলে গেল।
আরিবা ছুটে গিয়ে
ডায়েরিটা খুলল—চিঠি নেই।
চিঠি কেউ
নিয়ে গেছে…
রায়ান?
চিঠি কেউ নিয়ে গেছে… রায়ান?
পর্ব
৩: "চুপিচুপি ফিরে আসা"
"সব সময় ফিরে আসা কোলাহল নিয়ে হয় না… কিছু ফিরে আসা হয় নিঃশব্দে, চোখের পেছনে, হৃদয়ের স্পন্দনে।"
আরিবা ডায়েরিটা খুলে বসে। পাতায়
পাতায় খোঁজে রায়ানের সেই চিঠির উত্তর,
যেটা সে লিখেছিল কিন্তু
কখনও পাঠায়নি।
চিঠিটা নেই।
হাত কাঁপে, শ্বাস
ধরা পড়ে।
সে কি ভুল জায়গায়
রেখেছিল?
না, সে নিশ্চিত—চিঠিটা ডায়েরির ভাঁজেই রেখেছিল।
তাহলে চিঠি গেল কোথায়?
হঠাৎ করে মনে
পড়ে যায়—ফারিস!
সে-ই বলেছিল, "রায়ানের
চিঠি আমি দেখেছি…"
তাহলে কি ফারিস-ই
চুরি করে নিয়েছে সেই
চিঠি?
তবে সে কিসের
উদ্দেশ্যে তা করল?
অবিশ্বাস? হিংসা?
নাকি ভালোবাসার একটা আত্মিক প্রতিযোগিতা?
এক নতুন সকাল
আরিবার মা ডেকে বলেন,
—"মেয়ে, আজকে এক মেহমান
আসছে। খুব ভদ্র, মাশাল্লাহ
আল্লাহভীরু ছেলে। তুমি একটু বসবে,
কথা বলবে?"
আরিবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে
যায়।
বিয়ের আলোচনা? এখন?
—"আমি প্রস্তুত না
মা…"
—"সব সময় কি
কেউ প্রস্তুত থাকে মা? সময়ই
মানুষকে প্রস্তুত করে।"
আরিবা কিছু বলল না।
মাথা নিচু করে নিজের
রুমে ফিরে এল।
কিন্তু তার বুকের গভীরে
একটা অজানা অস্থিরতা—
রায়ান কি জেনে গেলে?
সন্ধ্যার আগে হঠাৎ এক ফোন কল
নাম নেই। নম্বর
সেভ করা না।
ভয়েসটা শুনেই গা শিউরে উঠলো।
—"আপু… এটা আমি,
রায়ান।"
আরিবার গলা শুকিয়ে গেল।
—"তুমি… কোথায় ছিলে এতদিন?"
—"তোমার চিঠিটা পেয়ে আর থাকতে
পারিনি। হ্যাঁ, আমি নিয়েছি সেটা।
ফারিস দিয়েছিল।"
—"ফারিস?"
—"হুম। ও চায়নি আমি
ফিরে আসি। কিন্তু ওর
মধ্যে একটা সম্মানবোধ ছিল—তোমার সিদ্ধান্তের উপর বিশ্বাস। তাই
চিঠিটা আমাকে দিয়ে বলেছে, ‘যদি
পড়ার পরও তোর সাহস
থাকে, তবে ফিরিস।’”
আরিবার চোখ বেয়ে অশ্রু
নামে।
ফারিস… হয়তো সে সত্যিই
শুধু ভালোবাসার অধিকার চেয়েছিল, জোর নয়।
—"তুমি এখন কোথায়
রায়ান?"
—"তোমার বাসার কাছে। তোমার ছাদে… সেই জায়গায় যেখানে
আমরা প্রথম চুপচাপ বসেছিলাম।"
আরিবা ছুটে ছাদে যায়।
সন্ধ্যার অন্ধকারে ছাদের কোণায় একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে…
মুখে কোনো হাসি নেই,
চোখে এক সমুদ্র অপেক্ষা।
আরিবা ধীরে ধীরে কাছে
গিয়ে দাঁড়ায়।
—"তুমি তো বলেছিলে…
ফিরে আসবে না?"
—"তুমি তো বলেছিলে… আমি
অনুপস্থিতিতে তোমার ভিতরটা অস্থির করে দিই।"
আরিবার চোখে অশ্রু।
—"তুমি এখনো চাইছো
এই ভাঙা মনকে?"
—"আমি চাই না শুধু
মন… আমি চাই তোমার
ভাঙা-পড়া প্রতিটা অনুভব,
আমি চাই তোমার অনিশ্চয়তা,
তোমার ভয়… সবকিছু। কারণ
আমি জানি, আল্লাহ আমাদের ভাঙা অংশগুলোকে জোড়া
লাগানোর জন্য কাউকে কাউকে
পাঠান।"
আরিবার ঠোঁট কাঁপে। তার
চোখে আজ ভয় নেই,
বরং এক ধরনের আত্মসমর্পণ।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে—
আরিবার মা ছাদে উঠে
এসে বললেন,
—"আরিবা, তুমি কি জানো
কে এসেছে আমাদের বাসায়? ওর নাম হাশিব।
হাফেজ, দীনদার, মেয়ে দেখে বিয়ের
প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।"
রায়ান স্তব্ধ।
আরিবা মুখ নিচু করে
দাঁড়িয়ে।
—"তোমার মা কি জানে…
আমি এই ছাদে আছি?"
আরিবা কোনো উত্তর দেয়
না।
রায়ানের চোখে তীব্র কষ্ট।
—"তাহলে তুমি এখনো প্রস্তুত
না, তাই তো?"
আরিবা তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে… রায়ান
চলে যায়।
পর্ব
৪: "প্রস্তাব আর প্রতীক্ষা"
"ভালোবাসা সবসময় সহজ হয় না… আর যখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ধর্ম, দায়িত্ব আর পরিবারের ইচ্ছা—তখন হৃদয়ের শব্দগুলো নিঃশব্দেই হারিয়ে যায়।"
ছাদ থেকে নেমে
আরিবা আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
চোখে চোখ রেখে
তাকায়। নিজের মনের ভেতর নিজেই
প্রশ্ন করে—
"তুই কি ভালোবাসিস রায়ানকে?"
"তবে চুপ করিস কেন?"
নীচে বসার ঘরে
হাশিব বসে।
একজন শান্ত, মার্জিত হাফেজুল কুরআন। চোখে পর্দানশীলতা, কথায়
বিনয়।
আরিবার মা খুশিতে চোখ
মেলে তাকিয়ে আছেন।
—"এই ছেলে হলে নিশ্চিন্ত
থাকা যায়। দীন আছে,
দুনিয়া আছে। কোরআনের হাফেজ,
পড়াশোনাও করেছে, পরিবারও খুব ভালো।"
আরিবার দৃষ্টি ঘোলাটে।
সে কেবল মাথা
নিচু করে বলে,
—"আমি ভেবে দেখব মা…"
রাত গভীর হলে…
রায়ানের ফোন আসে না।
কোনো মেসেজও না।
আরিবা চুপচাপ তার চিঠিগুলো পড়ে।
সেই প্রথম চিঠি… যেখানে রায়ান লিখেছিল:
"ভালোবাসা মানে শুধু ‘পাওয়ার’ কথা না আরিবা…
ভালোবাসা মানে কাউকে তার ভয়-দ্বিধা-ভাঙা মনসহ গ্রহণ করা।"
আর এবার সে
বুঝতে পারে—
রায়ান চেয়েছিল তাকে জোর না
করে, তার সিদ্ধান্তের উপর
আস্থা রাখতে।
পরদিন সকালে এক চিঠি… হ্যাঁ, আবার একটি চিঠি!
বাইরে পায়রা ঘরে একটা ছোট্ট
খাম।
আরিবার নাম লেখা।
তাকে চেনে এমন
কারও হাতের লেখা।
চিঠিতে লেখা:
"আমি যাচ্ছি, আরিবা।
হয়তো আল্লাহর কসম
করে বলি—আমি ভালোবাসতাম।
কিন্তু হয়তো এই ভালোবাসা
হালাল রাস্তায় নিয়ে যেতে আমি
দেরি করে ফেলেছি।
হাশিব যদি তোমার জন্য
সহজ রাস্তা হয়—তবে আমি
হার মানি।
আমি অপেক্ষা করব…
একদম শেষ সময় পর্যন্ত।
যদি কোনো দিন তুমিই
বলো—‘চলো, এবার হারাম
থেকে হালালের পথে যাই’—
তাহলে আমার ঠিকানা এখনো
একই থাকবে।
—রায়ান"**
চিঠির শেষে একটা আয়াত:
“وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجْعَل لَّهُۥ مَخْرَجًۭا”
(যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য পথ খুলে দেন। —সূরা তালাক: ২)
আরিবার বুক কাঁপে…
সে ছুটে গিয়ে
মাকে জিজ্ঞেস করে,
—"মা, হাশিব ভাই কি আজ
আবার আসবেন?"
—"হ্যাঁ, আজ নামাজের পর
তারা আনুষ্ঠানিক কথা বলতে চায়।
তুমি হ্যাঁ বললে কেবলই এগোবে।"
—"আর যদি আমি
না বলি?"
—"তবে হাশিবরা অপমানিত
হবে। আর তুমি তো
বলেছিলে ভেবে দেখবে!"
আরিবার বুকের ভেতর থেমে যায়
কিছু।
তার মনে হচ্ছে—সে
দেরি করে ফেলেছে।
হাশিব আসে। এবার তার সাথে তার বড় ভাইও।
সবাই বসে।
হাশিব শান্তভাবে বলে—
—"আমি বিয়েতে সম্মত,
কিন্তু আগে একটা কথা
বলি।"
সবাই অবাক হয়ে
চুপ।
—"আপার চোখে আমি
এমন কিছু দেখেছি… যেন
তার হৃদয় অন্য কোথাও
আবদ্ধ। আমি চাই না
আমার স্ত্রী মুখে হাসুক, কিন্তু
মনে কেউ আরেকজন থাকুক।"
আরিবার মাথা নিচু, ঠোঁট
কাঁপে।
—"আপা, আপনি কি
রায়ান ভাইকে ভালোবাসেন?"
ঘর নিস্তব্ধ।
আরিবার চোখে জল।
—"ভালোবাসি…"
মা আঁতকে উঠলেন।
—"কিন্তু সে তো—"
হাশিব থামিয়ে বলল,
—"সে যদি চরিত্রবান হয়,
ইসলাম মেনে চলে, এবং
আপনাদের সম্মান করে—তাহলে তার
জন্য এই প্রস্তাবটা আপনি
নিজেই দিন খালাম্মা। কারণ
একজন নারীর মুখে সত্যিকারের ভালোবাসা…
আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।"
পর্ব
৫: "হালাল ভালোবাসার দাওয়াত"
"কিছু ভালোবাসা দেরিতে আসে, কিছু ভালোবাসা সঠিক সময়েই। কিন্তু যা হালাল পথে আসে—তা শান্তি হয়ে জীবনকে ভরিয়ে দেয়।"
ঘড়ির কাঁটা তখন
ঠিক দুপুর বারোটা।
আরিবার মা নীরবে বসে
আছেন।
তিনি পুরো রাত ঘুমাননি।
বাবা কিছু বলেননি,
তবে তার চোখে ছিল
এক ধরনের সম্মান।
মেয়ের চোখে যে সত্যিকারের
ভালোবাসার অশ্রু, তা কোনো বাবা
এড়াতে পারে না।
তারা বুঝতে পেরেছেন—রায়ানকে হারানো মানে শুধু একজন প্রেমিককে হারানো নয়, বরং একজন আত্মার সঙ্গীকে চিরতরে মুছে ফেলা।
অতঃপর… একটি ফোন কল
রায়ান এখনো দেশে, কিন্তু
সে কিছুটা দূরে এক মাদ্রাসায়
কিছুদিনের জন্য পড়াশোনা করছে,
আত্মবিশ্লেষণের জন্য।
আলাদা থেকেও সে নিয়মিত তাহাজ্জুদ
পড়ে, দোয়া করে।
আর এবার…
সেই দোয়া কবুল হলো।
আরিবার মা-ই ফোন
করেন রায়ানকে।
—"বাবা রায়ান, তুমি
এখনো আরিবার জন্য অপেক্ষা করো?"
রায়ান স্তব্ধ। তারপর বলেন,
—"আন্টি, আমি তো কেবল
দোয়া করেছি। সিদ্ধান্ত আপনি-আপারা নিবেন।"
—"তোমার দোয়া কবুল হয়েছে
বাবা। আগামী শুক্রবার তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের আক্দ
করতে চাই।"
রায়ান কেঁপে ওঠে। অজান্তেই সেজদায়
পড়ে যায়।
আক্দের দিন
ছিমছাম একটা ছোট আয়োজন।
নারী-পুরুষ আলাদা।
নিখুঁত ইসলামি রীতিতে কেবল একজন ক্বারী,
দুজন সাক্ষী, আর দুই পরিবার।
আরিবার ঘরে চোখে পানি।
রায়ান অন্য ঘরে, হাতে
তসবিহ।
ক্বারী সাহেব জিজ্ঞেস করেন,
—"আপনারা কি আল্লাহর নামে,
স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় একে অপরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছেন?"
আরিবা একটু থেমে, চোখ
বন্ধ করে বলে,
—"হ্যাঁ।"
রায়ান বলে,
—"হ্যাঁ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, এই দায়িত্ব আমি
গ্রহণ করছি।"
রাতে, আক্দের পর প্রথম কথা
রায়ান ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে।
আরিবা ধীরে ধীরে আসে।
পর্দা মেনে দূরত্ব রেখে
দাঁড়ায়।
রায়ান বলে—
—"আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর শব্দটা আজ শুনলাম—তোমার
মুখে বলা ‘হ্যাঁ’ শব্দটা।"
আরিবা হেসে বলে—
—"আর আমি প্রথমবারের মতো
কাউকে ভয় ছাড়াই ভালোবাসতে
শিখলাম।"
রায়ান বলল—
—"চলো, এবার আমরা একসাথে
হেঁটে যাই—পাপে নয়,
প্রশান্তিতে।"
তারা একে অপরের
দিকে তাকিয়ে থাকে।
কোনো প্রেমের উত্তাপ নয়,
বরং এক ধরনের পবিত্র নিশ্চিন্তি যেন তাদের ঘিরে
রাখে।
শেষ দৃশ্য:
রায়ান আরিবার দিকে তাকিয়ে বলে—
—"এই সম্পর্ক শুরু হলো আজ,
কিন্তু দোয়া কর যেন
শেষটা হয় জান্নাতে।"
আরিবার চোখে জল।
সে মাথা নিচু করে
বলে—
—"আমিন।"
শেষ কথাঃ
"তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যারা তাদের প্রেমকে হালাল করেছে, অপেক্ষা করেছে, কষ্ট সয়ে গেছে—কিন্তু কখনো হারাম পথ বেছে নেয়নি।"
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ