ভুল ঠিকানার ভালোবাসা

শেষ বিকেলের প্রতীক্ষা

পরিচিতির শুরু

শেষ বিকেলের প্রতীক্ষা

মেঘমালার জীবনটা ছিল খুবই সাধারণ। গ্রামের সেই ছোট্ট বাড়ি, আর সকাল-বিকেলের নির্জন নদীর পাড় তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গাছের ছায়ায় বসে বই পড়া ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ।

একদিন বিকেলে, নদীর পাড়ে বসে বই পড়ছিল সে। হঠাৎ করেই পাশের পথ দিয়ে এক অচেনা মানুষকে আসতে দেখল। ছেলেটি দেখতে অদ্ভুত! পরনে ঝুলঝুলে জিন্স, কাঁধে ব্যাকপ্যাক। একটু অগোছালো, তবে চোখে-মুখে একধরনের আত্মবিশ্বাস।

"তোমার পাশে বসতে পারি?" ছেলেটি সরাসরি জিজ্ঞেস করল।

মেঘমালা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "হ্যাঁ, পারো।"

ছেলেটি বসে পড়ল, আর নিজ থেকেই আলাপ শুরু করল। "আমি অরূপ। পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরি। এই গ্রামে এসেছি একটু শান্তি খুঁজতে। তুমি এখানে থাকো?"

"হ্যাঁ, আমি এখানকারই। নাম মেঘমালা," মৃদু হেসে উত্তর দিল সে।

সেদিন কথার শুরুটা হয়েছিল একেবারে সাদামাটা। কিন্তু তাদের আলাপ যত বাড়তে থাকল, ততই মেঘমালা অনুভব করল অরূপের প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব।


 বন্ধুত্বের বাঁধন

এরপরের দিনগুলোতে অরূপ প্রায়ই আসত নদীর পাড়ে। তাদের কথোপকথনের বিষয় ছিল নানা রকম—জীবনের গল্প, বই, গান, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। মেঘমালার নির্জন জীবনে অরূপ যেন এক ঝলক নতুন বাতাস নিয়ে এসেছিল।

"তোমার এই গাছটা কেমন যেন মজার," একদিন অরূপ বলল। "যেন এটা শুধু তোমার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছে।"

মেঘমালা হেসে বলল, "হয়তো। কিন্তু তুমিও তো একজন পথিক। আজ আছো, কাল চলে যাবে।"

অরূপ তার দিকে তাকাল, একটু গম্ভীরভাবে। "সব পথিক কি ফিরে যায়?"

মেঘমালা কোনো উত্তর দিল না।


 প্রেমের সূচনা

একদিন বিকেলে অরূপ বলল, "জানো, আমি পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরেছি। কিন্তু কখনো কোথাও থেমে যেতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু এখানে এসে কেন জানি মনে হয়, থেমে যেতে পারি।"

মেঘমালার বুকটা ধক করে উঠল। কিন্তু সে কিছু বলল না। অরূপের কথাগুলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল।

একদিন, মেঘমালা সাহস করে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি কখনো নিজের জীবন নিয়ে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখেছো?"

অরূপ একটু চিন্তা করে বলল, "হয়তো দেখেছি। কিন্তু সব স্বপ্ন বাস্তব হয় না।"

মেঘমালা অনুভব করল, তাদের সম্পর্কটা অন্যরকম। বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি, তবে প্রেমের নাম দেওয়ার মতো সাহস কারোরই নেই।

শেষ বিকেলের প্রতীক্ষা

বিচ্ছেদ

একদিন, অরূপ জানাল, তাকে আবার যেতে হবে। এই গ্রাম, এই নদীর পাড় ছেড়ে।

"তুমি কি ফিরে আসবে?" মেঘমালা জিজ্ঞেস করল।

অরূপ কোনো উত্তর দিল না। শুধু বলল, "সব পথিকেরই ফেরার পথ থাকে না। কিন্তু মনে রেখো, এখানে আমার একটা স্মৃতি থাকবে।"

সেই দিনটা ছিল মেঘমালার জন্য সবচেয়ে কষ্টের। অরূপ চলে গেল, আর মেঘমালার জীবন আবার আগের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে গেল।

 নতুন জীবন

সময়ের সাথে সাথে মেঘমালা নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখল। সে লেখালেখি শুরু করল এবং গ্রামের শিশুদের পড়াতে লাগল।

কিন্তু তার মন থেকে অরূপের স্মৃতি মুছে যায়নি। তার মনে হতো, অরূপ হয়তো একদিন ফিরে আসবে।

অন্যদিকে, অরূপের জীবনও বদলে গিয়েছিল। তার পরিবার তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করল। কিন্তু বিয়ের পরেও সে মেঘমালার কথা ভুলতে পারেনি।

 অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন

পাঁচ বছর পরে, এক বিকেলে মেঘমালা নদীর পাড়ে বসে ছিল। হঠাৎ, পেছন থেকে একটা কণ্ঠ শুনল।

"তুমি এখনো এখানে?"

মেঘমালা ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল, অরূপ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে সেই পুরোনো হাসি।

"তুমি ফিরে এলে?" মেঘমালা বিস্ময়ে বলল।

অরূপ মৃদু হেসে বলল, "হ্যাঁ, ফিরে এসেছি। মনে হচ্ছিল, তোমার কাছে না আসলে আমি শান্তি পাব না।"

তারা অনেকক্ষণ ধরে গল্প করল। জানা গেল, অরূপের বিয়ে টেকেনি। সে তার ভ্রমণের জীবনে ফিরতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনো কিছুই তাকে মেঘমালার স্মৃতি থেকে মুক্তি দিতে পারেনি।

শেষ বিকেলের প্রতীক্ষা

সেদিন নদীর পাড়ে শেষ বিকেলের আলো যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

মেঘমালা বলল, "তুমি এবার কি থামতে চাও?"

অরূপ একটু থেমে বলল, "হ্যাঁ, এবার থামতে চাই। তোমার সঙ্গে।"

নদীর স্রোত বয়ে চলল, কিন্তু তাদের জীবনে যেন সময় থমকে দাঁড়াল।