- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
রিমার সকাল
১৫ বছরের রিমা থাকত শহরের এক বস্তিতে। বাবা ইদ্রিস মিয়া রিকশা চালাতেন, আর মা সেলিনা বাড়িতে কাজ করতেন। পরিবারের জন্য রিমা ছিল আশার আলো। কিন্তু এই আশার আলো জ্বলতে গিয়ে কত অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, সেটা রিমা তখনো জানত না।
রিমার দিন শুরু হতো ভোরে। বস্তির পাশের কুয়ো থেকে পানি নিয়ে আসা, বাসন ধোয়া আর মায়ের কাজে সাহায্য করা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। তবে রিমার হৃদয়ের গভীরে একটা স্বপ্ন ছিল—সে একদিন স্কুলে যাবে, বড় কিছু হবে।
---
শিক্ষা নিয়ে লড়াই
মা একদিন বলেছিলেন, "মেয়ে হয়ে বেশি স্বপ্ন দেখা ঠিক না। তুমি বড়জোর কাজ শিখে মানুষের বাসায় কাজ করতে পারবে।"
কিন্তু রিমা চুপ করে থাকেনি। বস্তির পাশের সরকারি স্কুলে নাম লিখিয়ে এসেছিল নিজের জেদে। স্কুলের ইউনিফর্ম ছিল পুরোনো, আর বইগুলো করিম চাচার দেওয়া পুরনো বই।
প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে রিমা দেখল, তার মতো আরও অনেক গরিব ছেলে-মেয়ে সেখানে পড়তে আসে। কিন্তু তারা কেউ স্বপ্ন দেখে না, কেবল আসে সময় কাটাতে। রিমা ভাবল, "আমি আলাদা হব। আমাকে বড় হতে হবে।"
কঠিন বাস্তবতা
স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন বস্তির ছেলেদের কটূক্তি শুনতে হতো। তারা বলত, "স্কুলে গিয়ে কী হবে? কাজ কর, টাকা আয় কর।"
রিমা এসব পাত্তা দিত না। তবে একদিন এক বিপদ ঘটে। স্কুল থেকে ফেরার পথে রিমার ওপর একটা ছেলে আচমকা বাজে মন্তব্য করে। রিমা ভয় পায়, কিন্তু প্রতিবাদ করে।
বাসায় ফিরে মা-কে বললে মা বলেন, "তোর এমন সাহস কেন? চুপচাপ থাকবি, কোনো ঝামেলায় যাবি না।"
রিমা কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমার তো কিছু ভুল ছিল না। কেন আমি কথা বলব না?"
স্বপ্নে বাঁধা
একদিন ইদ্রিস মিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের টানাপোড়েন আরও বেড়ে যায়। মা রিমাকে বলেন, "তোর স্কুল ছাড়তে হবে। আমরা তোর পড়াশোনার খরচ চালাতে পারব না।"
রিমা মনে মনে ভাবল, "পড়াশোনা আমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। এটা আমি কোনোভাবেই ছাড়ব না।"
রিমা নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বাসায় কাজ নেওয়া শুরু করল। সকালে স্কুলে যেত, আর বিকেলে এক গার্মেন্টসে ছোটখাটো কাজ করত।
---
গার্মেন্টসের জীবন
গার্মেন্টসের কাজ ছিল কঠিন। ঘামে ভেজা পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাপড় সেলাই করা। প্রথম দিন কাজ করতে গিয়ে রিমার হাত কেটে যায়। ম্যানেজার হেসে বলে, "হাত কেটেছে তো কী? কাজ শেখ।"
রিমা চুপচাপ সহ্য করে। তার চোখে একটাই লক্ষ্য—নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া।
---
বন্ধু সাবিনা
গার্মেন্টসে কাজ করতে করতে রিমার পরিচয় হয় সাবিনার সঙ্গে। সাবিনা তার মতোই গরিব ঘরের মেয়ে, কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়।
সাবিনা বলে, "জানিস, আমি একদিন গার্মেন্টসের ম্যানেজার হব। শুধু কাজ করলে হবে না, শিখতে হবে।"
রিমা সাবিনার কাছ থেকে কাজ শেখা ও আরও দক্ষ হওয়ার পাঠ নেয়।
---
পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা সামনে। রিমার কাজের চাপে পড়াশোনা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
তবুও, তার মনে একটা জেদ কাজ করে। রাত জেগে পড়তে বসে। একদিন সাবিনা তাকে বলে, "তুই তো পাগল হয়ে যাবি। একটু বিশ্রাম নে।"
রিমা উত্তর দেয়, "বিশ্রাম নিলে স্বপ্ন পূরণ হবে না।"
পরিবার ও সমাজের চাপ
পরিবারের আর্থিক চাপ আরও বাড়তে থাকে। মা প্রায়ই বলে, "তুই শুধু নিজের স্বপ্ন নিয়ে ভাবছিস, আমাদের কথা ভাবছিস না।"
রিমা কষ্ট পায়, কিন্তু হাল ছাড়ে না। সমাজের কটূক্তি, পরিবারের চাপ—সবকিছু সহ্য করে সে পড়াশোনা চালিয়ে যায়।
---
ছোট সাফল্য
পরীক্ষার ফল বের হয়। রিমা তার ক্লাসে প্রথম। শিক্ষকরা তাকে উৎসাহ দেন।
কিন্তু এই সাফল্যে পরিবারের আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। রিমা বুঝতে পারে, তাকে আরও বড় কিছু করতে হবে।
---
দুর্ঘটনা ও আশা
একদিন গার্মেন্টসে কাজ করার সময় মেশিনের ত্রুটিতে সাবিনা মারাত্মক আহত হয়। এই ঘটনা রিমাকে নাড়া দেয়।
সে বুঝতে পারে, গার্মেন্টসের এই কঠিন জীবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আরও পড়াশোনা করতে হবে।
---
নতুন লক্ষ্য
রিমা সাবিনার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, "আমি শিক্ষক হব। আমি এমন শিশুদের জন্য কাজ করব, যারা পড়াশোনা করতে চায় কিন্তু পারে না।"
শহরের আলো
রিমা ধীরে ধীরে তার স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যায়। স্কুল শেষ করে সে একটি এনজিওর সাহায্যে কলেজে ভর্তি হয়। এরপর একদিন সে শিক্ষিকা হয়।
রিমা তার মতো বস্তির মেয়ে-মেয়েদের পড়ায়, তাদের স্বপ্ন দেখায়।
নিজের আলো জ্বালানো
বছর পেরিয়ে যায়। রিমা এখন শুধু একজন শিক্ষিকা নয়, একজন সমাজকর্মী। সে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে, স্বপ্ন আর সাহস থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়।
একদিন রিমা তার মাকে বলেন, "মা, তোমার কথা শুনলে আমি হয়তো বড় হতে পারতাম না। কিন্তু আজ আমি নিজেই তোমার গর্ব।"
গাইডের খোঁজে
কলেজে পড়তে গিয়ে রিমা প্রথমবার নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। স্কুলের পড়াশোনা তুলনামূলক সহজ ছিল, কিন্তু কলেজের পড়া অনেক বেশি জটিল। তার সহপাঠীরা সবাই প্রাইভেট টিউটর রাখত, আর রিমার সেই সামর্থ্য ছিল না।
একদিন ক্লাস শেষে রিমা তার শিক্ষক আহমেদ স্যারের কাছে গিয়ে বলে, "স্যার, আমি কিছু বিষয় বুঝতে পারছি না। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন?"
স্যার রিমার পড়াশোনার আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, "তুমি প্রতিদিন স্কুল শেষে আমার কাছে আসবে। আমি তোমাকে পড়া বুঝিয়ে দেব।"
আত্মবিশ্বাসের পরীক্ষা
কলেজের বার্ষিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা ঘোষণা করা হয়। রিমার বন্ধু মায়া তাকে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে।
রিমা বলল, "আমি কখনো এত বড় মঞ্চে কথা বলিনি। যদি সবাই হাসে?"
মায়া উত্তর দেয়, "তোর তো অনেক কিছু শেখার ইচ্ছা! ভয় পাস কেন? এটা তোর জন্য একটা সুযোগ।"
বিতর্কের দিন, রিমা সাহস করে মঞ্চে ওঠে। তার বক্তব্য ছিল গরিব মেয়ে-মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। রিমা তার নিজের সংগ্রামের গল্প দিয়ে বিচারকদের মন জয় করে।
জীবনের টানাপোড়েন
একদিন হঠাৎ রিমার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। রিমা তার সঞ্চিত টাকার সবটাই মায়ের চিকিৎসায় খরচ করে।
সেই রাতে রিমা একা বসে কাঁদছিল। সাবিনা তাকে ফোন করে বলে, "তুই শক্ত থাক। তোর মায়ের মতো আমি তোকে বলছি, তুই এই দুঃসময়ে নিজের স্বপ্ন ভুলিস না।"
---
ছোট চাকরি, বড় আশা
কলেজের খরচ চালানোর জন্য রিমা একদিন স্থানীয় একটি গ্রন্থাগারে খণ্ডকালীন চাকরি নেয়। গ্রন্থাগারে কাজ করতে গিয়ে সে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার সুযোগ পায়। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন তার চোখে নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়।
---
সম্মানিত অতিথি
কলেজের শেষ বর্ষে রিমা স্থানীয় একটি অনুষ্ঠানে সমাজে নারীদের ভূমিকা নিয়ে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত একজন এনজিও কর্মকর্তা তার বক্তব্য শুনে বলেন, "আপনার চিন্তাভাবনা অসাধারণ। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা আছে?"
রিমার জীবন এই প্রস্তাবের মাধ্যমে নতুন মোড় নেয়।
---
নিজের পথ তৈরি
রিমা এনজিওর হয়ে কাজ করতে শুরু করে। সে বস্তির মেয়ে-মেয়েদের নিয়ে একটি শিক্ষাকেন্দ্র চালু করে। প্রতিদিন স্কুল শেষে সে এই কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পড়ায়।
একদিন একটি মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, "আপা, আমি কি একদিন আপনার মতো হতে পারব?"
রিমা মৃদু হেসে বলে, "আমার চেয়েও বড় কিছু হতে পারবি। কেবল নিজের স্বপ্নগুলো ধরে রাখবি।"
---
শেষ অধ্যায়: আলো থেকে আলো
বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। রিমা এখন একজন সম্মানিত শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবী। তার কাজের জন্য একদিন একটি জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়।
পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে রিমা বলে, "আমার সাফল্যের পেছনে যারা ছিলেন, তারা আমার প্রেরণা। আমি চাই এই আলো আরও বহু মানুষের জীবন আলোকিত করুক।"
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ