ভুল ঠিকানার ভালোবাসা

সত্যিকারের সৌন্দর্য

সত্যিকারের সৌন্দর্য

 গাছের নিচে বসে থাকা ছোট্ট কাকের বাচ্চাটার মুখটা বিষণ্ণ। চারপাশে যতই হৈ-চৈ হোক, তার চোখে-মুখে কেমন যেন এক অদ্ভুত নিরবতা। গাছের শাখায় বসে তার মা যেন কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সে তো কিছুতেই বুঝতে চায় না। একরকম জেদ করেই মাটিতে বসে রয়েছে।

এই বাচ্চা কাকটির নাম কাজল। নামটা দিয়েছিল এক বাচ্চা মানুষ, যে প্রায় প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এখানে এসে বসত। তাকে একদিন কাকের বাসায় খাবার দিতে দেখে তার মা বলে উঠেছিল, “তুমি তো একেবারে আমাদের পরিবারের মানুষ হয়ে গেলে। তোমার নাম কাজল, কাকের ছেলের মতো।”

কাজল ছোট থেকেই একটু আলাদা। অন্য কাকগুলো যেখানে দল বেঁধে মজায় মত্ত, সেখানে সে একা বসে আকাশ দেখতে ভালোবাসে। একদিন তার মা তাকে ডাকল,

সত্যিকারের সৌন্দর্য

“কাজল, এমন চুপচাপ হয়ে বসে থাকলে হবে? আমাদের মতো কাকেরা আকাশে উড়ে জীবনের আনন্দ খোঁজে, খাবার খোঁজে, নতুন জায়গা আবিষ্কার করে। তুমি কি এমন করে সারাজীবন বসে থাকবা?”

কাজল মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, আমি আকাশ ভালোবাসি। কিন্তু অন্যদের মতো শুধু খাবারের জন্য নয়, আমি ভালোবাসি আকাশের অজানা রহস্য খুঁজে পেতে। কিন্তু মা, এই আকাশ তো বিশাল। এই বিশালতা দেখে মাঝেমধ্যে আমার ভয় লাগে।”

তার মা হেসে বলল, “তুমি এত ছোট, কাজল। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু জানো, এই বিশাল আকাশ আমাদের জন্য এক বিশাল সুযোগও বটে। এই আকাশ আমাদের ইচ্ছার ডানায় ভেসে বেড়াতে শিখিয়েছে। ভয় নয়, আকাশকে ভালোবাসা শিখতে হবে। একদিন তুমি বড় হবে, ভয় নিজেই পালিয়ে যাবে।”

তবে কাজলের জীবনের আসল পরিবর্তন শুরু হলো যখন একদিন বৃষ্টি শেষে কাজল এক বিশাল গাছের নিচে একটা রঙিন পালক খুঁজে পেল। পালকটা তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জিনিস। এটি ঝকঝকে নীল আর গোল্ডেন রঙে মিশ্রিত ছিল। কাজল ভেবেই পেল না এত সুন্দর পালক এখানে এলো কীভাবে।

সত্যিকারের সৌন্দর্য

পরদিন কাজল আবার সেই জায়গায় ফিরে গেল। এবার সে দেখল পালকের মালিক, এক বিশাল ময়ূর। ময়ূরটি শান্তভাবে জলের ধারে দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্য মেলে ধরছিল। কাজলকে দেখে ময়ূরটি বলল,

“তুমি এখানে কী করছ, ছোট্ট পাখি? এই জায়গা তোমাদের মতো কাকেদের জন্য নয়।”

কাজল সাহস করে জবাব দিল, “আপনার পালকটা অনেক সুন্দর। আমি ভেবেছি, এর মালিক কেমন হবে। আপনি সত্যিই অনেক সুন্দর।”

ময়ূর হেসে বলল, “সৌন্দর্যের মধ্যে থেকেও আমি জানি, পৃথিবী আমাদের বিচার করে আমাদের বাইরের চেহারা দেখে। কিন্তু ভেতরের জগৎটা আসল সৌন্দর্য। তা জানার সাধ্য কি কাকদের আছে?”

কাজল সেইদিন ফিরে গিয়েও আর ফিরতে পারল না। প্রতিদিন সে ময়ূরের সাথে কথা বলার জন্য সেখানে যেত। ময়ূরও ধীরে ধীরে তার সঙ্গ পছন্দ করতে শুরু করল। একদিন কাজল ময়ূরকে জিজ্ঞেস করল,

সত্যিকারের সৌন্দর্য

“আপনার মতো হলে তো সবাই ভালোবাসবে। আমি ভাবছি, আমাকে যদি আপনাদের মতো সুন্দর বানানো যেত। তাহলে কি আমি আরও আনন্দে থাকতে পারতাম?”

ময়ূর বলল, “সুন্দর হলে কী হবে, কাজল? যাদের চোখে দেখার মতো মনের গভীরতা নেই, তাদের কাছে সবই একরকম। ভেতর যদি কিছু না থাকে, বাইরের সৌন্দর্য একদিন ম্লান হয়ে যায়।”

কাজল সেই কথার মানে তখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। কিন্তু সে ঠিক করল, সে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করবে। নিজের গায়ের কালো রং ছেড়ে নতুন কিছু হবে। এভাবেই দিন কাটতে থাকল। একদিকে তার মায়ের কথা, অন্যদিকে ময়ূরের উদাসীনতা, কাজলকে ভিতরে ভিতরে আরও কিছু খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করল।

সত্যিকারের সৌন্দর্য

একদিন কাজল আকাশে ওড়া শুরু করল। সে একের পর এক জায়গা আবিষ্কার করল। কোথাও পাহাড়ের মাথায় একলা দাঁড়িয়ে ছিল, কোথাও বিশাল ফুলের বাগান দেখে তার মনে হলো—এটাই আসল সৌন্দর্য।

সে তখন বুঝতে শিখল, সৌন্দর্য আসলে দেখা বা রংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সৌন্দর্য সেই চোখে যা নতুন কিছু খুঁজতে পারে, এবং যে হৃদয় গভীরভাবে অনুভব করতে পারে।

ফিরে আসার পথে কাজল ময়ূরের জন্য একটি বিশেষ উপহার নিয়ে আসল। সেটি ছিল একটি কালো ফুল—একেবারে তার নিজের মতো। কাজলের মনে হয়েছিল, কালো রংয়ের মাঝেও এমন কিছু আছে যা সুন্দর।

সত্যিকারের সৌন্দর্য

ময়ূর এই উপহার দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। বলল,

“তুমি প্রমাণ করেছ, কাজল। সত্যিকারের সৌন্দর্য ভেতরে লুকিয়ে থাকে। আমি এই প্রথম আমার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। তুমি না হলে আমি কখনো নিজের ভেতরের ভ্রম ভাঙতে পারতাম না।”

সেদিন থেকে কাজল আর ময়ূরের বন্ধুত্বের গল্প শুরু হলো। কিন্তু এই গল্প শুধু এক কাক আর ময়ূরের গল্প নয়, এটা আমাদের সবার গল্প। বাইরের চাকচিক্যের বাইরে গিয়ে যদি আমরা ভেতরের সত্যকে দেখতে শিখি, তাহলে সত্যিকার অর্থেই জীবন পূর্ণতা লাভ করে।

More...........