- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শহরের গলিটা সোজা হলেও, জীবন সবসময় সোজা পথে চলে না। ধুলো জমা রাস্তাগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ হেঁটে যায়, কিন্তু কেউ কি কারও গল্প জানে? হয়তো না। অথচ, এই জনস্রোতের মধ্যেই একদিন দেখা হয়ে যায় এমন কারও সাথে, যাকে দেখার পর মনে হয়—এটাই বুঝি সেই মানুষ, যার জন্য অপেক্ষা ছিল এতদিন!
তেমনই এক গলিতে, এক বিকেলের গল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল রাহাত আর মেঘলার গল্প।
রাহাত শহরের নামকরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। খুবই সাধারণ, কিন্তু গভীর চিন্তাধারার একজন মানুষ। ফটোগ্রাফির প্রতি তার এক অদ্ভুত ভালোবাসা, যেখানে সে খুঁজে নেয় জীবনের রঙ, আনন্দ, দুঃখ আর নিঃসঙ্গতার গল্প।
মেঘলা, নামের মতোই রহস্যময়। যেদিন প্রথম দেখা হলো, সেদিন সে ছিল আকাশের মতো শান্ত। একপাশে বসে বই পড়ছিল ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে। হঠাৎ করে রাহাতের ক্যামেরার লেন্স গিয়ে থামে তার মুখের উপর।
তার চোখে ছিল একধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ—যেন কোনো হারানো স্বপ্নের গল্প লুকিয়ে আছে সেখানে।
রাহাত ভুল করেই তার একটা ছবি তুলে ফেলে। ক্যামেরার পর্দায় সে দেখতে পায় এক টুকরো সৌন্দর্য, যা বর্ণনাতীত।
"আপনি কি এভাবে অচেনা মানুষের ছবি তুলে ফেলেন?"
মেঘলা সরাসরি প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠে ছিল না কোনো রাগ, ছিল কেবল বিস্ময়।
রাহাত একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
"না... মানে... আমি আসলে এই ক্যাম্পাসের সবকিছুই ক্যামেরায় ধরে রাখি। আপনি যদি চান, আমি ছবিটা ডিলিট করে দিতে পারি।"
মেঘলা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, "দেখতে পারি?"
রাহাত ক্যামেরাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। মেঘলা এক নজর দেখে একটু মুচকি হাসল।
"একটা ভালো ছবি তুলেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে একটা শর্ত দিচ্ছি।"
"কী শর্ত?"
"আপনি যদি এই ছবিটা রাখতে চান, তবে আপনাকে আমাকে একটা ছবি তুলতে দিতে হবে।"
রাহাত অবাক হয়ে গেল। এই মেয়ে কি মজা করছে, নাকি সিরিয়াস?
কিন্তু সে হাসল, এবং ক্যামেরাটা তুলে বলল, "ঠিক আছে, আপনি কখন তৈরি?"
মেঘলা তখন ক্যাম্পাসের সিঁড়ির ধারে গিয়ে দাঁড়াল। হালকা বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, রোদের আলো তার চোখে ঝলসে উঠছিল। সেই মুহূর্তে, ক্যামেরার লেন্সের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যেন কেবল একজন মানুষ নয়, বরং একটা সময়ের গল্প হয়ে উঠল।
সেই একটা ছবি তুলেই রাহাত বুঝে গিয়েছিল, সে বিপদে পড়েছে। কারণ তার মন বলে দিচ্ছিল, এই মেয়েটির সাথে তার জীবনের গল্পটা এখন শুরু হতে চলেছে।
নীরব বন্ধুত্বের দিনগুলো
এরপর থেকে রাহাত আর মেঘলার মাঝে একটা নীরব বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। তারা প্রতিদিন কথা বলত না, কিন্তু মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে দেখা হয়ে যেত। কখনও লাইব্রেরিতে, কখনও ক্যান্টিনে, আবার কখনও করিডোরে।
মেঘলা একটু কম কথা বলত। তার ভেতরে একটা রহস্য ছিল, যা রাহাত বুঝতে পারত না। কিন্তু তার এই নিরবতাই ছিল তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক।
রাহাত প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ছবি তুলত, আর অপেক্ষা করত—মেঘলা কখন আসবে!
একদিন হঠাৎ মেঘলা বলল, "তুমি কি সবকিছুর ছবি তুলতে ভালোবাসো?"
"হ্যাঁ। কারণ আমার মনে হয়, সময়কে ধরে রাখার একমাত্র উপায় এটাই।"
"সবসময় কি সবকিছু ধরে রাখা যায়?"
"হয়তো না... কিন্তু চেষ্টা করাই তো জীবন।"
মেঘলা কিছু বলল না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল।
সেদিনের পর থেকে মেঘলা আর রাহাতের বন্ধুত্ব একটু গভীর হতে শুরু করল। তারা একসাথে বসে গল্প করত, সিনেমা নিয়ে আলোচনা করত, একসাথে বৃষ্টিতে ভিজত, রাস্তায় হাঁটত। কিন্তু রাহাত কখনো সরাসরি মেঘলাকে বলেনি, সে কী অনুভব করে!
কিন্তু তার চোখ সব বলে দিত।
একদিন বিকেলে মেঘলা তাকে বলল, "তুমি কি কখনো ভাবো, কেউ যদি হুট করে হারিয়ে যায়, তাহলে কেমন লাগে?"
রাহাত অবাক হয়ে তাকাল।
"মানে?"
"মানে, ধরো কেউ যদি হঠাৎ একটা শহর ছেড়ে চলে যায়, বা আর কখনও ফিরে না আসে?"
রাহাত চিন্তায় পড়ে গেল।
"কেন এই প্রশ্ন করছ?"
মেঘলা একটু হাসল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটা অদ্ভুত বিষাদ ছিল।
"কিছু না... কেবল জানতে চাইলাম।"
সেইদিন রাহাতের মনে একটা ভয় ঢুকে গেল।
কেন যেন মনে হচ্ছিল, মেঘলা তাকে কিছু লুকিয়ে রাখছে।
একটি অসমাপ্ত গল্প
দিন যেতে থাকল, কিন্তু রাহাতের মনে একটা অস্থিরতা বাড়তে লাগল।
সে অনুভব করল, মেঘলা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তা কমে যাচ্ছে, দেখা হওয়ার মুহূর্তগুলোও ক্রমশ কমে আসছে।
একদিন বিকেলে, মেঘলা হঠাৎ বলল, "আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, কিন্তু জানি না তুমি শুনতে চাইবে কি না।"
রাহাত একটু হাসল, "তুমি যদি বলতে চাও, তাহলে আমি অবশ্যই শুনব।"
মেঘলা গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
"আমি হয়তো এই শহর ছেড়ে চলে যাবো।"
রাহাতের শরীর জমে গেল।
"মানে?"
"আমার পরিবার চাইছে আমি অন্য একটা শহরে চলে যাই, পড়াশোনা শেষ করার জন্য। আমি হয়তো আর এখানে থাকব না।"
রাহাত বুঝতে পারছিল না, সে কী বলবে।
তার ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল।
সে শুধু বলল, "তুমি কি যেতে চাও?"
মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর আস্তে করে বলল, "আমি জানি না।"
সেদিন রাহাত প্রথমবার অনুভব করল, তার মনের কথাটা বলা দরকার।
কিন্তু সে কি বলবে?
সত্যিই কি সে মেঘলাকে ধরে রাখতে পারবে?
নাকি এই নীরব প্রেমটাও একসময় হারিয়ে যাবে, সময়ের মতো?
বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসে
রাহাতের মনে যেন হাজারটা প্রশ্ন দানা বাঁধছিল।
মেঘলা সত্যিই চলে যাবে?
সে কি কিছুই বলতে পারবে না?
এই অনুভূতিটা কি শুধু তার একার, নাকি মেঘলাও কিছু অনুভব করে?
কিন্তু মেঘলা কিছুই বলছিল না।
এরপরের কয়েকদিন মেঘলা খুবই ব্যস্ত ছিল। নতুন শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু রাহাতের সাথে ঠিক আগের মতো সময় কাটাত না।
রাহাতের কেমন জানি মনে হচ্ছিল, মেঘলা ইচ্ছা করেই দূরত্ব তৈরি করছে।
একদিন বিকেলে, ক্যাম্পাসের পরিচিত বেঞ্চে বসে রাহাত আর মেঘলা কথা বলছিল। মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "রাহাত, জীবন অনেক কিছু আমাদের থেকে কেড়ে নেয়, তাই না?"
রাহাত বিস্মিত হয়ে তাকাল, "তুমি এটা হঠাৎ বলছ কেন?"
মেঘলা হাসল, "কিছু না। কেবল মনে হলো, কিছু কিছু অনুভূতি বলার আগেই হয়তো হারিয়ে যায়।"
এই কথার অর্থ রাহাত তখন বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, মেঘলা যেন কিছু লুকিয়ে রাখছে।
অনুভূতি প্রকাশের দ্বিধা
মেঘলার বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসছিল।
রাহাত প্রতিদিনই ভাবত, সে কি মেঘলাকে বলে দেবে, তার মনের কথা?
কিন্তু বলা হয়ে উঠত না।
একদিন ইশান, রাহাতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, বলল, "দোস্ত, সময় চলে গেলে আর ফিরে আসবে না। তুই যদি ওকে কিছু বলতে চাস, আজই বল।"
রাহাত মাথা নেড়ে বলল, "কিন্তু যদি মেঘলা আমাকে ভুল বুঝে? যদি বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যায়?"
ইশান একগাল হেসে বলল, "পাগল! সম্পর্ক সত্যি থাকলে কিছুই নষ্ট হয় না। বরং সত্যিকারের ভালোবাসা তো বন্ধুত্বেরই উন্নত সংস্করণ।"
সেই রাতেই রাহাত ঠিক করল, সে আর চুপ করে থাকবে না।
স্টেশনের শেষ মুহূর্ত
বিদায়ের দিন সকালে রাহাত ক্যাম্পাসে এল, কিন্তু মেঘলাকে পেল না।
তারপর এক বন্ধু জানাল, মেঘলা স্টেশনে গেছে, ট্রেন ধরে চলে যাবে।
রাহাতের মাথা যেন ঘুরতে লাগল।
এটাই তাহলে শেষ?
সে আর সময় নষ্ট করল না, বাইক নিয়ে ছুটে গেল স্টেশনের দিকে।
স্টেশনে পৌঁছে দেখল, মেঘলা ট্রেনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা বই, চোখে কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি।
রাহাত দৌড়ে গিয়ে ডাকল, "মেঘলা!"
মেঘলা অবাক হয়ে তাকাল। "তুমি এখানে?"
রাহাত নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, "তোমার কাছে একটা উত্তর চাই।"
মেঘলা কৌতূহলী হয়ে তাকাল, "কিসের উত্তর?"
রাহাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "তুমি কি একবারও ভাবোনি, আমি কেমন থাকব তোমার না থাকায়?"
মেঘলার চোখ কেমন জানি অস্বাভাবিক ভাবে চকচক করছিল।
সে আস্তে করে বলল, "রাহাত, তুমি কি কখনও অনুভব করেছ, কেউ তোমাকে চাইলেও কিছু বলার সুযোগ পায় না?"
রাহাত একদম কাছে এগিয়ে এসে বলল, "তাহলে আমাকেও বলার সুযোগ দাও, মেঘলা। আমি তোমাকে ভালোবাসি!"
মেঘলা চুপ করে ছিল। চারপাশের শব্দ যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল।
তারপর ট্রেনের হুইসেল বাজল।
মেঘলা একটু এগিয়ে এসে বলল, "আমিও তোমাকে অনেক অনুভব করেছি, রাহাত। কিন্তু কিছু অনুভূতি বলার জন্য হয়তো খুব দেরি হয়ে যায়..."
রাহাত চুপ।
মেঘলার ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল।
রাহাত শুধু তাকিয়ে রইল, আর দেখল, মেঘলার চোখে জল।
কিন্তু সে কিছু বলল না।
কয়েক বছর পর...
রাহাত ক্যামেরা হাতে শহরের পুরনো সেই গলিটায় দাঁড়িয়ে ছিল।
অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, জীবন বদলে গেছে। কিন্তু কিছু স্মৃতি কখনও বদলায় না।
আজও, প্রতিটি বিকেলে, রাহাতের মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। সেই নীরব বন্ধুত্ব, সেই না বলা অনুভূতি, সেই স্টেশনের বিদায়...
একদিন হঠাৎ সে শুনল, মেঘলা এখন ফিরে এসেছে শহরে।
কিন্তু দেখা হবে কি?
এক বিকেলে, সেই পুরনো ক্যাম্পাসে হাঁটতে গিয়ে, রাহাত হঠাৎ দেখতে পেল—একটি পরিচিত মুখ।
হালকা বাতাসে উড়ে যাওয়া চুল, সেই একই শান্ত চোখ, সেই একই মিষ্টি হাসি...
মেঘলা!
রাহাত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
এবার কি তারা আবার শুরু করতে পারবে?
নাকি এই নীরব প্রেম চিরকালই নীরব থেকে যাবে?
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ