পর্ব ১: প্রথম দেখা
কলকাতার আকাশটা সেদিন যেন অঝোর বৃষ্টি দিয়ে কিছু বলে যেতে চাইছিল। সন্ধ্যার পর শহরের ব্যস্ততা একটু কমে এলেও হাওড়া ব্রিজের ওপারের বাতাস ভারী ছিল কুয়াশার মতো আবছা, যেন কিছু একটা হারানোর পূর্বাভাস।
অরাভ একটা ক্যাফের জানালার পাশে বসে ঝড় দেখছিল। টেবিলের ওপরে খোলা নোটবুক, পাশে আধখাওয়া কফির কাপ, আর সামনে শূন্য দৃষ্টি।
ঠিক তখনই সে প্রথমবার মীরাকে দেখে। বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গেছে, লাল রঙা ওড়নাটা শক্ত করে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, তার গভীর কালো চোখ দুটো ঝড়ের থেকেও বেশি অস্থির। কেউ একজন তাকে ডাকতে গিয়েও ফিরে গেল। যেন কেউ তার কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
অরাভ অজান্তেই নিজের ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
“আপনি ঠিক আছেন?” সে জিজ্ঞেস করল, ওর কণ্ঠে কিছুটা সংকোচ।
মীরা তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড, যেন ও কী বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর ধীরে বলল, “আমি… আমি আমার বাস মিস করেছি।”
কণ্ঠে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা। অরাভের মনে হলো, ও শুধু বাস না, আরও কিছু হারিয়েছে…
সেই দিনটিই ছিল তাদের প্রথম দেখা। কিন্তু এটা শুধু একটা কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। কিছু মানুষ প্রথম দেখাতেই দাগ কেটে যায় হৃদয়ের গভীরে।
পর্ব ২: একসঙ্গে পথচলা
অরাভ ছিল একজন লেখক, জীবনের মানে খুঁজত কাগজের পাতায়, কালির শব্দে। আর মীরা? সে ছিল একজন নৃত্যশিল্পী, যার নাচে জীবনের না বলা গল্প ফুটে উঠত।
তাদের দেখা আরও বাড়তে লাগল। বইয়ের দোকানে, পার্ক স্ট্রিটের ল্যাম্পপোস্টের নিচে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঘাসে বসে… কখনও হয়তো পরিকল্পনা করে, কখনও বা দৈবক্রমে।
“তুমি কী নিয়ে লিখো?” একদিন মীরা জানতে চাইল।
“ভালোবাসা নিয়ে,” অরাভ একটু হাসল।
“তাহলে আমাকে নিয়েও লিখবে একদিন?”
অরাভ চুপ করে গেল। কেন জানি মনে হলো, মীরা কথাটা বলল খুব গভীর ব্যথা লুকিয়ে রেখে।
সেই রাতে তারা গঙ্গার ধারে একসঙ্গে হাঁটছিল। হাওয়ায় মীরার চুল উড়ছিল, চোখেমুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। কিন্তু যখন সে এক মুহূর্তের জন্য দূরে তাকাল, অরাভ স্পষ্ট দেখল ওর চোখে চাপা কান্নার ছায়া।
কেন?
পর্ব ৩: এক অজানা ভয়
ভালোবাসা যেমন হৃদয়কে পূর্ণ করে, তেমনই একধরনের ভয়ও নিয়ে আসে। কিছু হারানোর ভয়।
একদিন মীরা হঠাৎ বলল, “অরাভ, যদি একদিন আমি হারিয়ে যাই, তুমি কি আমাকে খুঁজবে?”
অরাভ প্রথমে হেসে ফেলেছিল, কিন্তু মীরার গলা এতটাই গম্ভীর ছিল যে সে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এরকম বলছ কেন?”
মীরা তাকাল না, শুধু বলল, “মানুষ সব সময় তার প্রিয়জনদের ধরে রাখতে পারে না।”
অরাভ কিছু বলতে চেয়েও পারল না।
কিন্তু তখন সে জানত না, এই কথাগুলো সত্যি হবে এত তাড়াতাড়ি…
পর্ব ৪: নিখোঁজ মীরা
সেদিন রাতে অরাভ বারবার মীরাকে ফোন করল, কিন্তু কোনো উত্তর এল না। এটা কখনও হয়নি। মীরা কখনও ওর ফোন এড়িয়ে যেত না।
উদ্বিগ্ন হয়ে সে সোজা ছুটে গেল মীরার ফ্ল্যাটে। দরজাটা ভেজানো ছিল, ভেতর থেকে হালকা বাতাস আসছিল।
সে দরজাটা ঠেলে ঢুকতেই ধপ করে দাঁড়িয়ে গেল।
মীরার পুরো ঘর অন্ধকার, শুধু একটা মোমবাতির আলো টেবিলের ওপর টলমল করছে। চারপাশে বাতাসের ফিসফিসানি।
আর টেবিলের ওপর একটা চিঠি।
অরাভ ঠান্ডা হাত নিয়ে তুলে নিল চিঠিটা—
“অরাভ,
তোমার ভালোবাসা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, কিন্তু কিছু দুঃখ কখনও মুছে যায় না। আমি ক্লান্ত। এবার সময় হলো মুক্তি পাওয়ার।
দয়া করে আমাকে খুঁজতে যেও না।
ভালো থেকো।
– মীরা”
অরাভের হৃদয় লাফ দিয়ে উঠল। কী বলতে চাইছে মীরা? ও কোথায় গেল?
ঠিক তখনই, জানালা দিয়ে একদল মানুষের আওয়াজ এলো—
“এখানে একটা মেয়ে পড়েছে!”
পর্ব ৫: শেষ অধ্যায়
অরাভ ছুটে বেরিয়ে গেল। নিচে নামতেই ভিড়, মানুষের ফিসফাস, গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ছিটকে পড়া ছায়া।
মাটিতে পড়ে আছে একটা নিথর দেহ—গাঢ় নীল শাড়ি, চারপাশে গঙ্গার ধারের বাতাস, রক্তের ছোপ। চুলের মধ্যে মুখটা লুকিয়ে আছে, যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে।
অরাভ দৌড়ে গিয়ে ঝাঁকিয়ে তুলল সেই শরীর। চুল সরিয়ে দিলো ওর মুখ থেকে।
সেই মুখ… মীরা।
এক নিথর ঠোঁট, নিঃস্পন্দ চোখ, যেখানে আর কোনো ব্যথা নেই। যেন সে শান্তি খুঁজে পেয়েছে, যেখানে পৃথিবীর সব কষ্ট ফিকে হয়ে যায়।
“না! মীরা, না!”
অরাভ চিৎকার করে উঠল, কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না, কেউ বলল না— ‘এটা স্বপ্ন
’।
সত্যিই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
কলকাতার বাতাসে বৃষ্টি ঝরছিল, শহরের ব্যস্ততা চলতেই থাকল, কিন্তু এক প্রেমের গল্প এখানে এসে থেমে গেল।
মীরার জীবন যেমন নাচের ছন্দে কেটেছিল, ঠিক তেমন করেই এক ব্যথার মোহনায় থেমে গেল।
অরাভের হাতে কাগজের চিঠিটা উড়ছিল বাতাসে। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়তে লাগল, আর মীরার ঠাণ্ডা হাতে সে শক্ত করে চেপে ধরল—একটি শেষ বিদায়।
ভালোবাসা কখনও হারায় না, কিন্তু কিছু মানুষ ফিরেও আসে না।
more...