নিশির আলোর সেই গল্পটা শুরু হয়েছিল একটি রাত্রে। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, তবে চাঁদটা মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল। সেদিন অরিন্দম অফিস থেকে ফিরছিল একেবারে ক্লান্ত হয়ে। গলির মোড়ে এসে সে খেয়াল করল, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। শাড়ি পরা, হাতে একগুচ্ছ বই। চুলগুলো এলোমেলো, চোখে বিষণ্ণতা।
অরিন্দম প্রথমে ভেবেছিল পাড়া বাড়ি করছে। কিন্তু যখন দেখল মেয়েটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দশ মিনিট ধরে, তখন সে এগিয়ে গেল।
"ম্যাডাম, কিছু সমস্যা হয়েছে?" অরিন্দম জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটি চমকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল। তারপর আস্তে করে বলল, "আমার বাড়ি এখান থেকে অনেক দূর। বাসটা মিস করেছি। এখানে কেউ পরিচিত নেই। কী করব বুঝতে পারছি না।"
অরিন্দম ভেতরে ভেতরে একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। এত রাতে একটা অচেনা মেয়েকে সাহায্য করতে যাওয়া উচিত হবে কি না, সেটা ভেবে। কিন্তু তার মুখে এমন একটা নির্ভরতা ছিল, অরিন্দম সাহস করেই বলে উঠল, "আপনার যদি আপত্তি না থাকে, আমি আপনাকে ড্রপ করে দিতে পারি।"
মেয়েটি প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর এক গাল হাসি দিয়ে বলল, "ধন্যবাদ। আমি আসলে খুব অসহায় বোধ করছিলাম।"
অরিন্দম বাইক নিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি লাজুকভাবে পিছনের সিটে বসে পড়ল। বাড়ির ঠিকানা বলল, কিন্তু এত রাতে একটা অনাত্মীয় ছেলের সঙ্গে এইভাবে যাওয়া—মনের মধ্যে একটুখানি দ্বিধাও কাজ করছিল।
রাস্তার বাতিগুলো ম্লান আলো ছড়াচ্ছিল, আর বাইকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। এর মধ্যেই দুজনের মধ্যে ছোটখাটো কথা শুরু হলো। মেয়েটির নাম তৃণা। সে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছে। অরিন্দম প্রথমেই বুঝতে পারল, মেয়েটির কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা গভীরতা আছে।
যখন তৃণার বাড়ির সামনে পৌঁছাল, সে অরিন্দমকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামল। কিন্তু নামার সময় হঠাৎ পেছন ফিরে বলল, "আপনার নামটা কি জানতে পারি?"
অরিন্দম হেসে বলল, "অরিন্দম। আর আপনি তৃণা। আজ থেকে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল, তাই তো?"
তৃণা হাসল। চাঁদের আলোয় তার মুখটা যেন আরও মায়াবী লাগছিল। "ঠিক বলছেন। আবার দেখা হলে ভালো লাগবে।"
তৃণা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল, আর অরিন্দম বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। কিন্তু সেদিনের সেই হাসি, সেই গভীর চোখের চাহনি, কিছুতেই ভুলতে পারল না।
সেই রাতের ঘটনার পর অরিন্দম অনেকবার তৃণার কথা ভেবেছে। তবে তার ভেতরে লজ্জা আর দ্বিধা কাজ করছিল। একটা অচেনা মেয়ের জীবনে নিজে থেকে প্রবেশ করার কোনো অধিকার কি তার আছে? তবু তৃণার সেই হাসি আর চোখের গভীরতা মনে পড়লেই এক অজানা টান অনুভব করত সে।
এদিকে তৃণাও অরিন্দমকে ভুলতে পারেনি। এমন একজন অচেনা, কিন্তু নির্ভরযোগ্য ছেলের সঙ্গে এত রাতে দেখা হওয়ার ঘটনাটা তার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। তৃণা প্রতিদিন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকত, মনে মনে ভাবত—আবার যদি দেখা হয়ে যায়!
দিন কেটে গেল। ঠিক এক সপ্তাহ পর, এক সন্ধ্যায়, অরিন্দম ঠিক করল তৃণার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবে। কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু দেখতে চাইছিল মেয়েটিকে। বাইক নিয়ে তৃণার পাড়ার সামনে পৌঁছে দেখল, ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা। তার চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, আর তার চোখ আকাশের দিকে।
অরিন্দম সাহস জোগিয়ে বাইক থামাল। নিচ থেকে তিনি চিৎকার করে বললেন, "তৃণা!"
তৃণা চমকে নিচে তাকাল। প্রথমে সে বিস্মিত হয়েছিল, কিন্তু পরমুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। "আপনি এখানে?"
অরিন্দম একটু লজ্জা নিয়ে বলল, "হ্যাঁ, ভেবেছিলাম আপনার খবর নেব। সেদিনের পর থেকে আর কথা হয়নি।"
তৃণা নিচে নেমে এল। "এটা সত্যি বড় চমক। আসুন, একটু ভেতরে আসুন।"
অরিন্দম প্রথমে দ্বিধা করলেও তৃণার নিমন্ত্রণ ফেরাতে পারল না। তৃণার বাড়ি খুব সাধারণ, কিন্তু খুব সুন্দর। একটা ছোট উঠোন, ফুলের টব, আর ভেতরে দেয়ালে বাংলা সাহিত্যের কবিতা টাঙানো।
তৃণা বলল, "আমি চা বানাচ্ছি। চা খাবেন তো?"
অরিন্দম মুচকি হেসে বলল, "যদি তোমায় বিরক্ত না করি, তবে অবশ্যই।"
চা তৈরি হতে হতে তাদের মধ্যে গল্প শুরু হলো। তৃণা জানাল, সে রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ দাশের বড় ভক্ত। তার স্বপ্ন একদিন বড় লেখক হওয়ার। অরিন্দম মুগ্ধ হয়ে শুনল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অরিন্দম হেসে বলল, "আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, সাহিত্য আপনার জীবন।"
তৃণা মাথা নাড়ল। "হ্যাঁ, কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়, বাস্তব জীবনের গল্পগুলোই সবচেয়ে সুন্দর।"
অরিন্দম একটু থমকাল। "তাহলে আজকের এই ঘটনাটা বাস্তব জীবনের গল্পের মতো লাগছে কি?"
তৃণা একটু হেসে বলল, "লাগছে। হয়তো এটা একটা নতুন গল্পের শুরু।"
সে রাতের গল্প তাদের সম্পর্কের সূচনা ছিল। সেই রাতের পরে তারা নিয়মিত দেখা করতে শুরু করল। গল্প, কবিতা, আর জীবনের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে তাদের আলোচনা চলতে লাগল। কিন্তু এই বন্ধুত্বের গভীরতায় যে প্রেমের এক সূক্ষ্ম স্রোত বয়ে চলেছে, সেটা তখনো তারা বুঝতে পারেনি।
তৃণা আর অরিন্দমের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আরও গভীর হতে লাগল। তাদের মধ্যে যে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে, সেটা তারা নিজেরাও টের পাচ্ছিল।
তৃণা প্রায়ই অরিন্দমকে তার লেখা কবিতা শোনাত। একদিন একটি পার্কে বসে তৃণা তার ডায়েরি খুলে একটি কবিতা পড়ে শোনাল।
তুমি এলে নীরব রাতে,
চুপিচুপি যেন এক চাঁদের আলো।
তোমার মুখে শোনা গল্পগুলো
আমার হৃদয়ের আকাশে একেকটি তারা হয়ে ঝরে।"**
কবিতাটি শুনে অরিন্দম হেসে বলল, "এটা কার জন্য লেখা?"
তৃণা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, "জানেন না। আপনি যদি বোঝেন, তাহলে উত্তর আমিই নেব।"
অরিন্দম অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তৃণার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, তৃণার চোখের ভাষা অনেক কিছু বলছে। কিন্তু সে সরাসরি কিছু বলতে সাহস করল না।
দিন যেতে লাগল, আর তৃণা ও অরিন্দমের সম্পর্কটা একটা মিষ্টি অথচ অস্পষ্ট অনুভূতির দিকে এগোতে থাকল। তবে এই সময় একটা বাধা এল।
অরিন্দমের অফিস থেকে তাকে ট্রান্সফারের প্রস্তাব দেওয়া হলো। এটা তার ক্যারিয়ারের জন্য খুব বড় সুযোগ। কিন্তু তার মানে তাকে কলকাতা ছেড়ে চেন্নাই যেতে হবে। খবরটা শুনে তৃণার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
"তাহলে কি তুমি চলে যাবে?" তৃণার কণ্ঠস্বরে বিষণ্ণতা স্পষ্ট।
অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, "এটাই ঠিক মনে হচ্ছে। কিন্তু তোমার সঙ্গে এই সম্পর্কটা—আমি সত্যিই চাই না, এটা কোনোভাবে হারিয়ে যাক।"
তৃণা কিছুক্ষণ কিছু বলল না। তারপর আস্তে করে বলল, "তুমি যদি যাও, আমি বুঝব এটা তোমার স্বপ্নের জন্য। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা কথা শোনো, অরিন্দম।"
অরিন্দম তাকাল তার দিকে। তৃণা বলল, "আমার জন্য তোমার মধ্যে যদি সামান্য কিছু অনুভূতি থাকে, তাহলে সেটা একবার বলতে দ্বিধা কোরো না। কারণ কিছু না বলে চলে যাওয়া হয়তো আমাদের গল্পটা অসম্পূর্ণ করে দেবে।"
অরিন্দম তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে হচ্ছিল, যেন তৃণার মধ্যে অগণিত প্রশ্ন আর অগাধ ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। সে কি সাহস করে সেই অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করবে? নাকি তৃণার জীবনে একটি অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে?
অরিন্দম সেদিন পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি। তৃণার কথা বারবার তার মনে পড়ছিল। তৃণার সেই গভীর চোখ, তার বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর—সবকিছুই যেন অরিন্দমের ভেতরে একটা তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
সকালে অফিসে গিয়ে অরিন্দম ট্রান্সফার নিয়ে বসের সঙ্গে আলোচনা করল। সে চেন্নাই যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। কিন্তু তার মনে একটা সিদ্ধান্ত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল—তৃণাকে কিছু না বলে চলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
সেদিন সন্ধ্যায় তৃণাকে একটা কফি শপে ডেকে পাঠাল। তৃণা এসে দেখল, অরিন্দম খুবই চিন্তিত মুখে বসে আছে।
"তোমার মুখটা এমন শুকনো কেন?" তৃণা মৃদু হেসে বলল, যদিও তার চোখের গভীরে চাপা উদ্বেগের আভাস ছিল।
অরিন্দম একটু মাথা নিচু করে বলল, "তৃণা, একটা কথা তোমাকে আজ বলতেই হবে। অনেক দিন ধরে বলব বলব করে বলতে পারিনি। যদি এখন না বলি, তাহলে হয়তো কোনো দিনই বলা হবে না।"
তৃণা চুপ করে তাকিয়ে রইল। তার ভেতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল।
অরিন্দম একটা গভীর শ্বাস নিল। তারপর বলল, "তৃণা, আমি জানি আমাদের পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু এই অল্প সময়েই তুমি আমার জীবনে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছ, যা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। আমি জানি না তুমি কী ভাবো, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই কথাটা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এখন আমি জানি, যদি বলার সুযোগ মিস করি, তাহলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।"
তৃণা প্রথমে কিছু বলল না। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, "তুমি এত দেরি করেছ কেন?"
অরিন্দম অবাক হয়ে তাকাল। "মানে?"
তৃণা হালকা হেসে বলল, "আমি অনেক দিন ধরেই অপেক্ষায় ছিলাম। তবে এটা তোমার মুখ থেকেই শুনতে চেয়েছিলাম।"
অরিন্দমের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মনে হলো, সে যেন জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা জিতে গেছে।
তৃণা আবার বলল, "তবে একটা কথা। তুমি চেন্নাই যাবে, আমি জানি। কিন্তু দূরত্ব আমাদের ভালোবাসাকে দূরে সরাতে পারবে না। তুমি যদি আমার হাত ছাড়তে না চাও, আমি কখনো তোমার হাত ছাড়ব না।"
অরিন্দম তৃণার দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তৃণা। এই সম্পর্কটা কখনো ছিন্ন হতে দেব না।"
সেদিনের পর থেকে তৃণা আর অরিন্দমের সম্পর্কটা আরও গভীর হলো। অরিন্দম চেন্নাই চলে গেল, কিন্তু প্রতিদিন ফোনে কথা, চিঠি আদানপ্রদান, আর মাঝে মাঝে তৃণার কাছে ফিরে আসা তাদের ভালোবাসাকে অটুট রাখল।
তাদের গল্পটা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে দূরত্ব কিংবা সময় ভালোবাসার শক্তিকে হার মানাতে পারে না। আর এই গল্পটা সেই চাঁদনী রাতের মতোই মিষ্টি, অমলিন।