রাতের অন্ধকার শহরের চারপাশে নেমে এসেছে। ইট-পাথরের এই শহরের অজস্র কোলাহলে যেন এক ধরনের নির্জনতা লুকিয়ে থাকে। রুদ্র জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেই নির্জনতার সঙ্গে নিজের একাকিত্ব মিশিয়ে দিচ্ছিল। তার মনের ভেতর প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো সেই পুরনো কথাগুলো— "তুমি কি জানো, রুদ্র, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার মাঝখানের সীমানাটা কতটা সূক্ষ্ম?"
রুদ্রের জীবনে এই প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসে। আর এই প্রশ্নের সঙ্গে ফিরে আসে অরুন্ধতির হাসিমুখ। অরুন্ধতি—তার জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। একে অপরের ছায়াসঙ্গী ছিল তারা। তবে বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে রুদ্রের মনের কোণে জন্ম নিয়েছিল এক নিষিদ্ধ অনুভূতি—ভালোবাসা।
অরুন্ধতি ছিল সব সময়ে উচ্ছল, প্রাণবন্ত। তার চোখে ছিল স্বপ্নের এক জগত, যেখানে রুদ্র ছিল তার ভরসার আশ্রয়। কিন্তু রুদ্রের মনের গভীরে চলছিল এক দ্বন্দ্ব। বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে তাকে ভালোবাসার কথা বলা কি সঠিক হবে? নাকি এই বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যাবে?
অরুন্ধতির সঙ্গে রুদ্রের প্রথম দেখা হয়েছিল একটি বইমেলায়। বই নিয়ে অরুন্ধতির পাগলামি দেখে রুদ্র অবাক হয়ে গিয়েছিল। দু'জনেই ছিল কবিতা আর গল্পের ভক্ত। একে অপরের সঙ্গে কবিতার লাইন শেয়ার করতে করতে বন্ধুত্বটা দ্রুত গভীর হয়ে যায়। তাদের বন্ধুত্ব ছিল এতটাই গভীর যে, সবাই তাদের "আদর্শ বন্ধু" বলে ডাকত।
কিন্তু এই বন্ধুত্বের আড়ালে রুদ্রের হৃদয় গোপনে কাঁদত। অরুন্ধতির প্রতি তার অনুভূতি দিন দিন গভীর হচ্ছিল। একদিন যখন তারা পার্কে বসে আকাশের তারা দেখছিল, রুদ্র অরুন্ধতির দিকে তাকিয়ে ছিল চুপচাপ। সে বুঝতে পারছিল, অরুন্ধতি তার কাছে শুধু একজন বন্ধু নয়, তার জীবনের অর্থ হয়ে উঠেছে।
অরুন্ধতির জীবনে রুদ্র ছিল তার সুখের অংশ। কিন্তু রুদ্রের মনের ভেতর চলছিল এক অস্থিরতা। সে তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইত, কিন্তু ভয় পেত এই ভেবে যে, অরুন্ধতি যদি এই সম্পর্কটাকে ভুল বুঝে? একদিন হঠাৎ অরুন্ধতি তাকে বলে, "রুদ্র, আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। আমি একজনকে ভালোবাসি।"
এই কথা শোনার পর রুদ্রের বুকের ভেতর যেন সবকিছু ভেঙে পড়ল। সে কিছু বলতে পারল না। অরুন্ধতির মুখে সেই আনন্দের হাসি দেখে সে নিজের কষ্ট গোপন করে হাসি দিল। কিন্তু তার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিল। বন্ধুত্বের মুখোশ পরে সে অরুন্ধতির পাশে ছিল, কিন্তু তার হৃদয়ের প্রতিটি ধুকপুকিতে ছিল একমাত্র অরুন্ধতি।
অরুন্ধতির কথাগুলো রুদ্রকে দমিয়ে দিলেও, তার মনে অন্য রকম একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তার মধ্যে এক অসহ্য বেদনা কাজ করছিল। এতদিন ধরে নিজের অনুভূতিকে যেভাবে আড়াল করেছিল, আজ সেটা রক্তাক্ত মনের প্রান্তে এসে ধাক্কা খাচ্ছিল।
রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে সে বারবার সেই মুহূর্তটা স্মরণ করছিল। অরুন্ধতির মুখে অন্য একজনকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি তাকে এমন শূন্যতায় ফেলে দিয়েছে, যেন তার মনের সব রঙ ফিকে হয়ে গেছে।
রুদ্রর ভেতরের দ্বন্দ্ব তাকে এক মুহূর্তও শান্তি দিচ্ছিল না। একদিকে তার ভেতর প্রজ্জ্বলিত ছিল প্রেম, অন্যদিকে সে জানত এই অনুভূতি প্রকাশ করা মানে হতে পারে বন্ধুত্বের শেষ। এই ভয়েই সে এতদিন নিজেকে সংযত রেখেছিল। কিন্তু আজ তার সহ্যশক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
একদিন যখন বিকেলের মিষ্টি আলো জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছিল, রুদ্র সিদ্ধান্ত নিল, আর নয়। সে কথা বলবেই। সে ভাবল, "বন্ধুত্ব বাঁচানোর জন্য যদি আমি আমার মনের কথাগুলো এভাবে চিরকাল গোপন রাখি, তবে সেটা অন্যায় হবে। তাকে জানতেই হবে। অন্তত আমি সত্যি ছিলাম বলতে পারব।"
যে কথা মুখে বলা যায় না, সেটা হয়তো লেখা যায়। এই ভেবে রুদ্র একটি চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিল। সে এক গভীর রাতে টেবিলে বসে লেখায় মন দিল। তার কলম থেকে বের হল তার হৃদয়ের সব কথা:
_“অরুন্ধতি,
অনেকদিন ধরে একটি কথা বলতে পারিনি। আমরা একে অপরের বন্ধু হিসেবে কত আনন্দে দিন কাটিয়েছি, সে তো তুমিই জানো। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও আমার হৃদয়ের এক গোপন সত্য আজো তোমার কাছে অনাহুত হয়ে আছে।
তোমার প্রতি আমার যা অনুভূতি, তা বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। আমি জানি, এই কথাগুলো শোনার পর হয়তো আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবুও, আমি আর চুপ থাকতে পারছি না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি, অরুন্ধতি। তোমার হাসি, তোমার স্বপ্ন, এমনকি তোমার সবকিছুই আমার জীবনের জন্য বিশেষ কিছু। কিন্তু আমি জানি, তুমি হয়তো আমাকে ওইভাবে ভালোবাসো না। তাও আমি চাই তুমি জানো।
যদি আমার এই অনুভূতি তোমার কাছে বোঝার বাইরে হয়, তবে দয়া করে আমাকে ক্ষমা করো। তবে শুধু একটাই অনুরোধ, আমাদের বন্ধুত্ব যেন এই সত্যের ভরে শেষ না হয়ে যায়।"_
চিঠি লেখা শেষ করে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এত সাহস সঞ্চয় করে যে চিঠি লিখল, সেটা অরুন্ধতির হাতে পৌঁছে দেওয়াটাও তো একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মনে মনে সে ঠিক করল, এই বার্তা পৌঁছাবেই।
পরের দিন বিকেলবেলা অরুন্ধতিকে কল দিল রুদ্র। ফোনের ওপাশ থেকে অরুন্ধতি চিরপরিচিত উচ্ছ্বাসের সুরে বলল, "হ্যাঁ রুদ্র, কী হলো? কোথায় আছো?"
রুদ্র ঠোঁট কামড়াল। গলা শুকিয়ে গেলেও কোনোভাবে বলল, "তোমার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। পার্কে আসতে পারবে?"
"কী হলো? অনেক গুরুতর মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, আমি আসছি।"
পাঁচটার দিকে তারা পার্কে দেখা করল। অরুন্ধতি বরাবরের মতো প্রাণবন্ত। রুদ্র তাকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "এটা তোমার জন্য। বাসায় গিয়ে পড়বে।"
অরুন্ধতি অবাক হয়ে বলল, "কী আছে এর মধ্যে? এখনই বলো।"
"না, প্লিজ। বাসায় গিয়ে পড়ো।" রুদ্র এতটুকুই বলল, এবং কথা না বাড়িয়ে সেদিন বিদায় নিল।
রুদ্র সারারাত ঘুমোতে পারেনি। অরুন্ধতি চিঠিটা কীভাবে নেবে? ও কী রেগে যাবে? বন্ধুত্ব কি আর আগের মতো থাকবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই রাত কেটে যায়। সকালে অরুন্ধতি তার ফোনে কোনো মেসেজ বা ফোন করেনি। বিষয়টি তার মন আরও ভারি করে তোলে।
সত্যের মুখোমুখি
পরের দিন সকালে ফোন বেজে উঠল। অরুন্ধতির নামটা স্ক্রিনে দেখে রুদ্রর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে। সে ধীরে ফোন ধরে। ওপাশ থেকে হালকা গম্ভীর কণ্ঠে অরুন্ধতি বলে, "তুমি আর আমি আজ দুপুরে দেখা করি। তোমার চিঠিটার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছো না?"
রুদ্র চুপ করে থাকে। তার বুকের ভেতর আশঙ্কার কালো মেঘ জমতে থাকে।
দুপুরের রোদের মোলায়েম আলো পড়েছে শহরের প্রাচীন এক ক্যাফের জানালার ফাঁক গলে। রুদ্র অরুন্ধতির অপেক্ষায় বসে ছিল। তার হৃদস্পন্দন এত জোরে বাজছিল যে, মনে হচ্ছিল আশেপাশের সবাই তা শুনতে পাবে। সে জানত, আজকের এই সাক্ষাৎ সবকিছু বদলে দিতে পারে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অরুন্ধতি ক্যাফেতে ঢুকে রুদ্রের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে। তার মুখে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি। সেদিকে তাকিয়ে রুদ্র বুঝতে পারল না, এই নীরবতা সুখের, নাকি দুঃখের সূচনা।
"হাই!" বলে অরুন্ধতি চেয়ারে বসে। রুদ্র কথা শুরু করার আগেই অরুন্ধতি বলল, "তোমার চিঠিটা পড়েছি।"
হৃদয়বিদারক মুহূর্ত
অরুন্ধতি সরাসরি রুদ্রের চোখে তাকিয়ে বলে, "আমি জানতাম না তুমি এতদিন ধরে এসব অনুভব করছো। জানো, আমাদের বন্ধুত্ব আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অংশ। কিন্তু…"
‘কিন্তু’ শব্দটা শুনে রুদ্রের বুকটা কেঁপে উঠল। অরুন্ধতি থেমে একটু যেন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, "রুদ্র, আমি তোমার প্রতি ওইভাবে কিছু কখনো অনুভব করিনি। আমার জন্য তুমি আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। কিন্তু ভালোবাসা... সেটা কারো ইচ্ছায় আসে না। আমি কাউকে ভালোবাসি, এবং তার সঙ্গে আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি।"
প্রতিটা শব্দ যেন রুদ্রের মনের গভীর থেকে গোপন সমস্ত আশা এক লহমায় ভেঙে দিচ্ছিল। কিন্তু সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। মাথা নীচু করে মৃদু কণ্ঠে বলল, "আমি জানি, অরুন্ধতি। আমি জানি। তোমাকে কষ্ট দেওয়াটা আমার ইচ্ছা ছিল না। শুধু তোমাকে আমার সত্যিটা জানানোটা জরুরি ছিল।"
অরুন্ধতি রুদ্রের হাতটা ধরে নিল। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত বেদনার ছাপ। "তুমি একজন অসাধারণ মানুষ, রুদ্র। তুমি যে সাহস করে এটা বললে, তার জন্য তোমার প্রতি আমার সম্মান আরও বেড়ে গেল। আমি চাই না, এই অনুভূতি আমাদের বন্ধুত্বকে নষ্ট করুক। আমি চাই আমরা আগের মতোই থাকি।"
কিন্তু রুদ্র জানত, সেটা সম্ভব নয়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মানে নিজের হৃদয়ের উপর প্রতিনিয়ত আঘাত করা। তার ঠোঁটে একবার হাসি ফুটল, "আমি চেষ্টা করব, অরুন্ধতি।"
দূরত্বের শুরু
এরপরের দিনগুলোতে তাদের কথাবার্তা ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল। রুদ্র অনুভব করেছিল, অরুন্ধতির সামনে থাকা মানেই তার নিজের যন্ত্রণা বাড়ানো। সে নিজেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করল। অরুন্ধতিও বিষয়টা অনুভব করলেও কিছু বলল না। হয়তো সেও বুঝেছিল, কোনো কিছুই আগের মতো আর হবে না।
চিরতরে বিদায়
একদিন খবর আসে, অরুন্ধতি তার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। রুদ্র বিদায় জানাতে গেল না। তবে তাকে শেষ চিঠি লিখল:
_"অরুন্ধতি,
আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় তুমি ছিলে। কিন্তু কিছু গল্প চিরকাল অসম্পূর্ণ থেকে যায়, এবং এটাই হয়তো সেগুলোর সৌন্দর্য। আমি তোমার জন্য ভালোবাসা আর সুখ কামনা করি।
বিদায়, অরুন্ধতি।
তোমার রুদ্র।"_
ক্লান্ত ভালোবাসা
অরুন্ধতির চলে যাওয়ার পর, রুদ্র নিজের জীবনে নতুন করে পথ খুঁজতে লাগল। সে জেনেছিল, ভালোবাসা সবসময় না-পাওয়ার মধ্যেও অপূর্ণ সৌন্দর্য রেখে যেতে পারে। সে নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করল, মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে।