ভুল ঠিকানার ভালোবাসা

নুর ও সুমাইয়া: ভালোবাসার পথচলা

 এক ছাদের নিচে নতুন জীবন

নুর ও সুমাইয়া: ভালোবাসার পথচলা

নুরের সঙ্গে সুমাইয়ার বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস হলো। নতুন সংসার, নতুন দায়িত্ব—সবকিছুই ধীরে ধীরে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে দুজন। কিন্তু বিয়ের পরবর্তী জীবনের বাস্তবতা স্বপ্নের মতো মসৃণ হয় না সবসময়। ভালোবাসার পাশাপাশি সেখানে থাকে চ্যালেঞ্জ, আত্মত্যাগ ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন।


নুর একজন তরুণ ব্যবসায়ী। পড়াশোনা শেষ করেই সে পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। সে সহজ-সরল স্বভাবের একজন মানুষ, কিন্তু দায়িত্বশীল। ইসলামের নিয়ম-কানুন মানার চেষ্টা করে, নামাজ পড়ে, পরিবারের বড়দের সম্মান করে।


অন্যদিকে, সুমাইয়া সদ্য বিবাহিত একজন তরুণী, যার পুরো জীবনই বদলে গেছে এই তিন মাসে। বিয়ের আগে সে ছিল তার বাবার রাজকন্যা। কোনো কিছুর অভাব ছিল না তার জীবনে। তবে বিয়ের পর নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন, নতুন অভ্যাস—সবকিছুই তাকে নতুন করে শিখতে হচ্ছে। সেও ইসলামকে ভালোবাসে, পর্দা করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, কিন্তু গৃহস্থালির কাজে সে একেবারেই অভ্যস্ত ছিল না। আর এখানেই শুরু হলো প্রথম চ্যালেঞ্জ।


সংসারের প্রথম চ্যালেঞ্জ: বোঝাপড়ার সংকট

সকালবেলা নুরের ঘুম ভাঙতেই দেখে, আজ ফজরের জন্য তাকে কেউ ডাকেনি। সাধারণত মা থাকলে তিনিই ডাকতেন, কিন্তু এখন তো স্ত্রী আছে। বিছানায় পাশে তাকিয়ে দেখে, সুমাইয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার মনে একটু কষ্ট লাগলো, তবে সরাসরি কিছু বললো না। নামাজ আদায় করে সে অফিসে চলে গেল।


দুপুরে ফিরে দেখে, খাবার এখনো তৈরি হয়নি। সুমাইয়া তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ।

"তুমি কি ভালো আছো?" নুর জিজ্ঞেস করল।

সুমাইয়া হালকা হাসলো, "হ্যাঁ, তবে একটু শরীর খারাপ লাগছিল, তাই দেরি হয়ে গেছে।"


নুর কিছু বললো না। একটু কষ্ট লাগলেও সে বুঝতে পারছিল, সুমাইয়া এখনো পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারেনি।

কিন্তু আসল সমস্যা হলো রাতের খাবারের সময়। নুরের পরিবার বেশ বড়। মা, বাবা, ছোট ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে বসে খায়। নতুন বউ হিসেবে সুমাইয়ার দায়িত্ব ছিল খাবার আয়োজন করা। কিন্তু সে রান্না এখনো ভালো জানে না। তাই ভুল করেই তরকারিটা একটু বেশি লবণ দিয়ে ফেলেছিল।

খাবারের সময় নুরের ছোট ভাই একটু রসিকতা করে বললো, "ভাবি, আজ মনে হচ্ছে আমরা সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি!"

সবাই হেসে ফেললো। কিন্তু সুমাইয়া মাথা নিচু করে ফেললো। তার চোখে পানি চলে এলো।

নুর বুঝতে পারলো, এটা তার জন্য কঠিন মুহূর্ত। সে চুপচাপ খেতে লাগলো, কিন্তু মনে মনে ভাবলো, "আমি কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারি?"

নুর ও সুমাইয়া: ভালোবাসার পথচলা


বিবাহিত জীবনে ধৈর্য ও সহানুভূতি

রাতে নুর সুমাইয়ার কাছে গিয়ে বললো, "সুমাইয়া, জানো? রাসূল (সা.) বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দয়া ও মমতা থাকতে হবে। আমি চাই, তুমি ধীরে ধীরে শিখো। আমি তোমার পাশে আছি।"

সুমাইয়া অবাক হয়ে তাকালো, "তুমি কি আমার ওপর রাগ করোনি?"

নুর হেসে বললো, "আমি তো চাই, আমরা একসঙ্গে শিখি। আজ থেকে আমিও তোমার সঙ্গে রান্না শিখবো।"

সুমাইয়ার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে ভাবেনি, নুর এতটা সহানুভূতিশীল হবে।


এভাবেই শুরু হলো তাদের ভালোবাসার নতুন অধ্যায়।

নতুন জীবনের নতুন বাস্তবতা

সুমাইয়া ধীরে ধীরে সংসারের কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। রান্নার হাতও আগের চেয়ে অনেকটা ভালো হয়েছে। নুরের মা তাকে ধৈর্য ধরে শেখাচ্ছেন, আর নুরও প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে তার কাজের প্রশংসা করে।

তবে সব সংসারেই যেমন কিছু কঠিন সময় আসে, নুর ও সুমাইয়ার দাম্পত্য জীবনেও তা এল।


এক সন্ধ্যায় নুর বাড়ি ফিরে দেখলো, সুমাইয়া বেশ চুপচাপ। চোখ লাল হয়ে আছে, মুখেও হাসি নেই।

"কি হয়েছে, সুমাইয়া?" নুর জিজ্ঞেস করলো।

সুমাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর ধীরে ধীরে বললো, "তুমি কি জানো, আজ তোমার মা আমাকে কী বলেছেন?"


নুর কপালে ভাঁজ ফেললো, "কি বলেছেন?"

"তিনি বলেছেন, আমি নাকি এখনো পুরোপুরি সংসারের দায়িত্ব নিতে পারিনি। তিনি বলেছেন, আমি যথেষ্ট দায়িত্বশীল নই।"

নুর বুঝতে পারলো, সুমাইয়া কষ্ট পেয়েছে। সে শান্ত গলায় বললো, "মা আসলে আমাদের সবার ভালো চান। হয়তো তিনি তোমাকে আরো ভালোভাবে গড়ে তুলতে চান বলেই বলেছেন।"


সুমাইয়া বিরক্ত হয়ে বললো, "তাহলে কি আমি একদমই যোগ্য নই? সবসময় আমার ভুল ধরার কী দরকার?"


নুর জানতো, এই মুহূর্তে সুমাইয়া আবেগপ্রবণ হয়ে আছে। সে সরাসরি কোনো উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং ধীরে ধীরে বললো, "দেখো সুমাইয়া, রাসূল (সা.) বলেছেন, ধৈর্য হলো ইমানের অর্ধেক। সংসারে ধৈর্য ধরতে হয়, বিশেষ করে যখন পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। মা তোমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু তোমার কিছু অভ্যাস হয়তো এখনো তাদের কাছে নতুন মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।"


সুমাইয়া একটু নরম হলো। কিন্তু তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। নুর এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বললো, "আমি তোমার পাশে আছি। তুমি চাইলেই পারবে। শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, আর আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো।"


সুমাইয়া চোখ মুছলো, তারপর হালকা হাসলো, "তুমি কি জানো, আমি কেন এত বেশি কষ্ট পাই?"

"কেন?"

"কারণ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি চাই না, তোমার পরিবারের কেউ আমাকে ভুল বুঝুক। আমি চাই, তোমার মা আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসুক।"


নুর হেসে ফেললো, "তাহলে তো তুমি জিতেই গেছো! কারণ তুমি নিজের জায়গা থেকে আন্তরিক। আল্লাহ আন্তরিকতার মূল্য দেন। তুমি দেখবে, একদিন মা তোমাকে সত্যিই মেয়ের মতো ভালোবাসবেন।"

নুর ও সুমাইয়া: ভালোবাসার পথচলা


আর্থিক সংকটের ধাক্কা

কয়েক মাস পর, নুরের ব্যবসায়ে কিছু সমস্যা দেখা দিলো। কিছু বড় ক্লায়েন্ট তাদের পেমেন্ট বন্ধ করে দিলো, যার ফলে কোম্পানিতে একটা বড় ধাক্কা এলো।

নুর প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে পড়লো। অফিসে কাজের চাপও বাড়তে লাগলো।


সে রাতে বাড়ি ফিরে অনেক ক্লান্ত ছিল। খাওয়ার সময় একদম চুপচাপ ছিল, আর খাবার শেষ করেই ঘুমিয়ে গেল।

সুমাইয়া বুঝতে পারছিল, কিছু একটা হয়েছে। সকালে সে সাহস করে নুরকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি এত চিন্তিত কেন?"


নুর দীর্ঘশ্বাস ফেললো, "ব্যবসায়ে সমস্যা চলছে। বুঝতে পারছি না, কীভাবে সামলাবো।"

সুমাইয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।


তারপর সে বললো, "তুমি কি জানো, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ সেই ব্যক্তির পথ খুলে দেন, যে তাঁর ওপর ভরসা রাখে?"

নুর একটু ম্লান হাসলো, "ভরসা তো করছি, কিন্তু বাস্তবতাও তো কঠিন।"


সুমাইয়া বললো, "তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?"

"অবশ্যই!"

"তাহলে আমি চাই, তুমি আমাকে একবার তোমার ব্যবসায়ের ব্যাপারে বিস্তারিত বলো। আমি হয়তো তোমাকে কোনো ভালো পরামর্শ দিতে পারি।"

নুর প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিল। কিন্তু তারপর সে সুমাইয়াকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বললো।


সুমাইয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করলো, তারপর বললো, "তুমি কি জানো, আমি ছোটবেলায় বাবাকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করতাম? তিনি সবসময় বলতেন, ‘ব্যবসায় উন্নতি করতে হলে ধৈর্য রাখতে হয়, আর সবসময় নতুন কিছু চেষ্টা করতে হয়।’ তোমার কোম্পানি কি কোনো নতুন কৌশল নিতে পারবে?"

নুর ও সুমাইয়া: ভালোবাসার পথচলা
নুর চমকে গেলো।

সে ভাবলো, "হ্যাঁ, আমি যদি নতুন কিছু ট্রাই করি, তাহলে হয়তো সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবো।"

সে সুমাইয়ার পরামর্শ মতো তার ব্যবসার নতুন দিক নিয়ে কাজ শুরু করলো। আর আল্লাহর রহমতে ধীরে ধীরে সমস্যা কমতে লাগলো।


সন্তানের অপেক্ষা ও সম্পর্কের আরেক পরীক্ষা

বিয়ের এক বছর পার হয়ে গেলেও, সুমাইয়ার কোনো সন্তান হচ্ছিল না। পরিবারে এই নিয়ে একটু চাপ সৃষ্টি হতে লাগলো।


একদিন নুরের মা তাকে ডেকে বললেন, "সুমাইয়া কি ডাক্তারের কাছে গিয়েছে?"

নুর বললো, "হ্যাঁ, আমরা ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন, দুশ্চিন্তা কমালে ভালো হবে।"

নুরের মা একটু চিন্তিত গলায় বললেন, "আমি চাই, আমার নাতি-নাতনি দ্রুত আসুক।"

এই কথাগুলো সুমাইয়া শুনে ফেলেছিল।

রাতে সে চুপচাপ বসে ছিল। নুর এসে পাশে বসল।

"তুমি মন খারাপ করছো?"


সুমাইয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, "আমি তো আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেছি। কিন্তু তাও কখনো কখনো মনে হয়, আমি যদি মা হতে না পারি, তাহলে কি সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে?"

নুর গভীরভাবে তার হাত ধরলো, "তুমি জানো, রাসূল (সা.)-এর অনেক স্ত্রীও দেরিতে মা হয়েছেন, কেউ কেউ মা হননি। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা সবার জন্য আলাদা। আমরা কি তাঁর পরিকল্পনার ওপর ধৈর্য ধরতে পারবো না?"

সুমাইয়ার চোখ ভিজে উঠলো, "আমার বিশ্বাস আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে ভয় পাই।"

নুর তার কপালে চুমু দিয়ে বললো, "ভয় পেয়ো না, আমি আছি। আমাদের ভালোবাসা শুধু সন্তান দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। তুমি আমার জান্নাতের হুরের মতো, আল্লাহ আমাদের জন্য যা ভালো, সেটাই করবেন।"


সুখের পরিণতি

আল্লাহর রহমতে, কিছুদিন পর সুমাইয়া গর্ভধারণ করলো।


এই সংবাদে পুরো পরিবার আনন্দে ফেটে পড়লো। নুর সিজদায় লুটিয়ে পড়লো, আর সুমাইয়া চোখ বন্ধ করে আল্লাহর শোকর আদায় করলো।


সংসারের অনেক চড়াই-উতরাই তারা পেরিয়েছে, কিন্তু ধৈর্য, ভালোবাসা ও ইসলামের পথে থাকার কারণে তারা আল্লাহর রহমত পেয়েছে।


নুর সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, "তুমি জানো, এই পুরো সময়ে আমি একটা জিনিস শিখেছি?"

"কি?"

"যে ভালোবাসা শুধু দুনিয়াবি নয়, বরং জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য হয়, সেটাই সত্যিকারের ভালোবাসা।"


নুর ও সুমাইয়া: ভালোবাসার পথচলা

MORE.......