- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
অপেক্ষার শেষ প্রহর
রাত তখন প্রায় দুটো। জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলো বিছানার একপাশে এসে পড়েছে। নিস্তব্ধ রাত, মাঝে মাঝে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কুকুরের ডাক। নিশিতা জানালার পাশে বসে আছে, হাতে এক কাপ কফি, মনটা অস্থির। আজ এক বছর পর আদিত্য আসছে! তার হৃদয় উত্তেজনায় ধুকপুক করছে। মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা—যখন তারা একসঙ্গে সারাদিন কাটাতো, ছোট ছোট ব্যাপারে হাসতো, ঝগড়া করতো, আবার মিশে যেতো একসঙ্গে।
কিন্তু এক বছর! এই একটা বছর যে কীভাবে কেটেছে নিশিতার, তা সে নিজেই জানে। আদিত্যকে ছাড়া একেকটা রাত কেমন নির্জীব লেগেছে! আজ আবার সেই পুরনো অনুভূতিগুলো দোলা দিচ্ছে তার মনে।
ফোনটা হাতে নিলো সে। সময় রাত ২:১৫। ট্রেন কি লেট? এয়ারপোর্টে নামার পর এখনো কোনো মেসেজ দেয়নি আদিত্য। নাকি… ভুলে গেছে?
নিশিতা জানে, আদিত্য এমনটা করতে পারে না। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি প্রতিশ্রুতি সে সবসময়ই রেখেছে। কিন্তু মন কেন জানি ভয় পাচ্ছে, হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে।
হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করলো। নিশিতা তড়িঘড়ি করে স্ক্রিনের দিকে তাকালো।
— "এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছি, কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবো। অপেক্ষা করো।"
মেসেজটা দেখে নিশিতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। "তাহলে… ও আসছেই!"
পুরনো অনুভূতির ফিরে আসা
প্রায় আধাঘণ্টা পর কলিংবেল বাজলো। নিশিতার বুক ধপধপ করতে লাগলো। দরজা খুলতেই…
সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্য। চোখে একরাশ ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা হাসি। নিশিতা তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এতদিন পর সামনাসামনি দেখা!
— "কি রে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? দেখবি না আমি একটুও বদলাইনি?"
নিশিতা কিছু বললো না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আদিত্যকে। যেন এক বছর ধরে জমে থাকা সব আবেগ এক নিমেষে মিশে গেল। আদিত্যও তাকে শক্ত করে ধরে রাখলো।
— "আমি জানতাম তুই এরকম করবি," আদিত্য হাসলো, "তোর রাগ কমলো তো?"
— "পাগল! তোকে ছাড়া এই এক বছর কেমন কেটেছে জানিস?"
— "আমি জানি নিশু… আমিও প্রতিটা মুহূর্ত গুনেছি তোকে দেখার অপেক্ষায়।"
এই প্রথম নিশিতার চোখ ভিজে উঠলো। এক বছর ধরে যা যা জমে ছিলো, আজ যেন তা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে।
এক কাপ কফি আর হারিয়ে যাওয়া রাত
দুজনে বসেছিল ব্যালকনিতে। নিশিতা একটা কফির কাপ এগিয়ে দিলো আদিত্যর দিকে।
— "এক বছর পর আবার আমার হাতে বানানো কফি খাচ্ছিস। কেমন লাগছে?"
— "আগের মতোই অসাধারণ!" আদিত্য এক চুমুক দিয়ে বললো। "তুই জানিস, বিদেশের কোনো কফিই তোর হাতের মতো না!"
নিশিতা হাসলো, "বহু বছর পরেও যদি তুই এটা বলিস, আমি জানবো তুই সত্যি আমাকে ভালোবাসিস।"
আকাশের দিকে তাকিয়ে আদিত্য হেসে বললো, "ভালোবাসা কখনো কমে না নিশু। বরং দূরত্ব যত বাড়ে, অনুভূতিটা তত গভীর হয়।"
নিশিতা কিছু বললো না। রাত গভীর হচ্ছিল, কিন্তু তাদের গল্প শেষ হচ্ছিল না।
অতীতের ছোঁয়া
— "তুই মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটার কথা?"
— "অবশ্যই! তোকে প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল, তুই আমার জন্যই জন্মেছিস!"
— "হুহ, কী ভাব দেখ! তখন তো আমার একদমই পছন্দ ছিল না তোকে!" নিশিতা নাক উঁচিয়ে বললো।
— "হ্যা, ঠিক! কিন্তু আমি জানতাম একদিন তুইও আমায় ভালোবাসবি!"
— "আরে বোকা, আমি তো তখন থেকেই তোকে ভালোবাসতাম… শুধু স্বীকার করতে পারতাম না!"
আদিত্য একটু অবাক হলো, "সত্যি বলছিস?"
— "হুম! তুই যখন আমার জন্য দুপুরে গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতি, যখন আমাকে না জানিয়ে আমার পছন্দের বইগুলো এনে দিতি… তখন আমি বুঝেছিলাম, তুই আমার জন্য স্পেশাল!"
আদিত্য নিশিতার দিকে তাকিয়ে হাসলো, "তাহলে এতদিন লুকিয়ে রাখলি কেন?"
— "কারণ, আমি ভয় পেতাম যদি তুই আমায় ছেড়ে চলে যাস!"
আদিত্য নিশিতার হাত ধরে বললো, "এত দূরে গিয়েও কি আমি তোকে ভুলেছি?"
নিশিতা মাথা নাড়িয়ে বললো, "না… তুই সবসময় আমার ছিলি… আর থাকবি!"
রাত গভীর হলেও তাদের গল্পের কোনো শেষ নেই। ভালোবাসার গল্পগুলো এমনই হয়, না? সময় কেটে যায়, অনুভূতি বদলায়, কিন্তু সম্পর্কটা থেকে যায় আগের মতোই গভীর।
প্রেমের এক নতুন অধ্যায়
রাত তখন প্রায় তিনটা। আকাশের চাঁদ কিছুটা নুয়ে পড়েছে, কিন্তু নিশিতা আর আদিত্যর গল্প যেন শেষই হতে চায় না। এক বছর পর দুজন একসঙ্গে বসে আছে, অথচ মনে হচ্ছে সময় যেন থমকে গেছে। কিন্তু এই ফিরে আসার পেছনে কি শুধু ভালোবাসার টান? নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো অজানা সত্য?
অতীতের ছায়া
নিশিতা কফির কাপে হাত গলিয়ে বসেছিল, চোখদুটো কেমন জানি চিন্তিত দেখাচ্ছিল। আদিত্য বুঝতে পারছিল, কিছু একটা ওর মনে খচখচ করছে।
— "কি হলো নিশু? এত চুপচাপ কেন?"
— "তুই কি এবার চিরদিনের জন্য ফিরে এলি, নাকি আবার চলে যাবি?" নিশিতা সরাসরি প্রশ্ন করলো।
আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। হাওয়ায় যেন এক অদ্ভুত নীরবতা ভেসে বেড়াচ্ছে।
— "নিশু, আমি চেয়েছিলাম সবকিছু তোর মতো করে সাজাই। কিন্তু জীবন তো এত সহজ না, তাই না?"
— "মানে?" নিশিতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো।
— "আমি জানি, তুই চাইছিস আমি আবার দূরে না যাই। কিন্তু… কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, কিছু দায়িত্ব আছে।"
— "আদিত্য, তুই তো জানিস, আমি সবসময় তোর পাশে থাকবো। কিন্তু এবার যদি আবার চলে যাস, তাহলে আমি সত্যিই আর পারবো না!"
আদিত্য নিশিতার হাতটা শক্ত করে ধরলো।
— "আমি আর যেতে চাই না নিশু… কিন্তু কিছু সত্যি আছে যা তোকে বলা দরকার।"
নিশিতার বুক কাঁপছিল। এই গভীর রাতে, এই অনুভূতির জোয়ারে, কোনো দুঃসংবাদ শুনতে ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
লুকোনো সত্য
আদিত্য একটু গম্ভীর হয়ে বললো, "বিদেশে থাকাকালীন আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটেছে। আমি একটা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে কাজ করছিলাম, যেখানে আমাকে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এই প্রজেক্টের জন্য আমাকে আবার ডাকতে পারে।"
— "মানে তুই আবার চলে যাবি?"
— "আমি চাই না নিশু… কিন্তু যদি পরিস্থিতি বাধ্য করে?"
নিশিতা উঠে দাঁড়ালো, ব্যালকনির রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকালো। গভীর রাতের চাঁদটা যেন আরো ফ্যাকাশে লাগছিল।
— "তাহলে তুই আমাকে এভাবে আবার স্বপ্ন দেখাচ্ছিস কেন?"
— "কারণ আমি চাই, তুই আমার সঙ্গে থাকিস।"
নিশিতা একটু অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। "মানে?"
আদিত্য এবার হাসলো, "মানে, আমি তোকে বিয়ে করতে চাই নিশু!"
নিশিতার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
— "তুই কি সত্যি বলছিস?"
— "হ্যাঁ নিশু, আমি চাই, যেখানে যাই, তুই আমার সঙ্গে থাকিস। আমি চাই না আবার তোর থেকে আলাদা হয়ে যাই।"
নিশিতার চোখে জল চলে এলো। এতদিন ধরে সে যেটা শুনতে চেয়েছিল, সেটা আজ সত্যি হতে চলেছে?
এক নতুন শুরু
সকালের আলো আস্তে আস্তে ফুটে উঠছিল। নিশিতা আর আদিত্য সারারাত কথা বলেছে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছে।
— "তাহলে আমাদের পরিবারকে জানাতে হবে, তাই না?" নিশিতা বললো।
— "হুম, তবে আমি জানি, তোর বাবা প্রথমে রাজি হবে না। উনি সবসময় চেয়েছিলেন তুই একজন স্থির চাকরিজীবীকে বিয়ে করিস, যে বিদেশে থাকবে না।"
— "আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলবো। তুই যদি সত্যিই এবার আমাকে ছেড়ে না যাস, তাহলে সবকিছুই সম্ভব।"
আদিত্য নিশিতার হাত চেপে ধরলো। "আমি তোর হাতটা আর কখনো ছাড়বো না নিশু। এবার আমি সত্যি তোর পাশে থাকতে চাই।"
ভালোবাসার শেষ ঠিকানা
কয়েকদিন পর, পরিবারের সবাইকে জানানো হলো। প্রথমে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও, শেষমেশ তারা রাজি হলো।
এক মাস পর, এক চাঁদনী রাতে, যেখানে তাদের প্রেমের গল্প শুরু হয়েছিল, সেই ব্যালকনিতেই আদিত্য আর নিশিতা বসল। আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝলমল করছে, যেন তারা দুজনের ভালোবাসাকে আশীর্বাদ করছে।
— "আজ তোর সঙ্গে বসে, মনে হচ্ছে জীবনটা সত্যিই সুন্দর!" নিশিতা বললো।
— "সত্যিই তো! কারণ, জীবন তখনই সুন্দর হয়, যখন পাশে থাকে ভালোবাসার মানুষ!"
তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে তাদের গল্প পূর্ণতা পেল।
more......
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ