ভুল ঠিকানার ভালোবাসা

প্রাণের বন্ধু

প্রাণের বন্ধু


 বন্ধুত্বের শুরু

সপ্তাহ শেষে শহরের প্রান্তে একটা ছোট্ট ক্যাফেতে দেখা হয়েছিল ছয়জন বন্ধুর। তৃষা, রাহি, নীরা, আদ্রিত, সায়ান আর ইশান—একসময় স্কুলের দিনের আড্ডা আর হইহুল্লোড়ে কাটানো এই বন্ধুরা এখন ব্যস্ততার কারণে একে অপর থেকে অনেক দূরে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে সবার জীবনের গতি পাল্টে গিয়েছিল ,যে যাঁর ক্যারিয়ার, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছুটতে গিয়েছিল আলাদা পথে।


তৃষাই ছিল মূল উদ্যোক্তা, যে সবার ফোন করে এই রিইউনিয়নটির আয়োজন করেছিল। তার মনে হচ্ছিল, বন্ধুত্বগুলো আলাদা হয়ে যাওয়ার আগেই একবার সবাই একত্রিত হওয়া উচিত। সেই ভাবনাতেই সে একদিন হঠাৎ একটি গ্রুপ চ্যাট খুলে লিখে দিল,

"সপ্তাহের শেষে দেখা হওয়া যাক। আড্ডা আর পুরোনো দিনের গল্প করতে একবার হলেও জমবো সবাই।"

সবার কিছুটা দ্বিধা ছিল। পাঁচ বছরে কত কিছুই না বদলে গেছে , কেউ নিজের নতুন জীবনে অভ্যস্ত, কেউ পুরোনো ক্ষত ভুলতে ব্যস্ত। তবু সবার ভেতরে পুরোনো বন্ধুত্বের নস্টালজিয়া ছুঁয়ে যায়। অবশেষে সায়ান মজা করে রিপ্লাই করে,

"আমাদের পুরোনো ড্রামাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছি। নিয়ে আসো তোমাদের সেরা গল্প।"

প্রাণের বন্ধু

বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায়

ক্যাফের বড় টেবিলে বসে শুরু হলো আড্ডা। প্রথমদিকে সবাই একটু অস্বস্তি বোধ করছিল, কিন্তু তৃষার বুদ্ধিতে আড্ডাটা জমতে বেশি সময় লাগল না। স্মৃতিচারণে উঠে এলো ক্লাস বাং দেওয়া, টিচারের কাছে ধরা পড়া, আর একসঙ্গে ট্রিপে যাওয়ার গল্প। পুরোনো দিনগুলো যেন ধীরে ধীরে ফিরে আসছিল।


আদ্রিত সবসময় সবার মধ্যমণি ছিল। তার রসবোধ এবং মজার ছলে বলা কথাগুলো সবাইকে হেসে লুটোপুটি খাওয়াত। কিন্তু নীরা লক্ষ্য করছিল, ইশান একটু চুপচাপ। স্কুলের দিনগুলোতে ইশানই ছিল সেই ছেলেটি, যে নীরার সবসময় পাশে থাকত। এখন যেন দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত দুরত্ব।


অন্যদিকে তৃষা আর সায়ানের মধ্যেও আলাদা একটা টানাপড়েন কাজ করছিল। তৃষা সবসময় সায়ানকে তার সেরা বন্ধু ভাবত, কিন্তু সায়ানের বন্ধুত্বের মাঝে কি অন্য কোনো অনুভূতি লুকিয়ে আছে? এই ভাবনা তৃষাকে ঘিরে রেখেছিল।

 ঈর্ষার শুরু

আড্ডার মাঝেই সায়ান রাহির দিকে একটু বেশি মনোযোগী হয়ে উঠল। রাহি ছিল গ্রুপের সবচেয়ে প্রাণবন্ত মেয়ে। তার হাসি, গল্প বলার ধরন সবার মন ভালো করে দিত। কিন্তু সায়ানের এই বাড়তি মনোযোগ তৃষার ভেতরে একটা ছোট ঈর্ষার জন্ম দিল। তৃষা হঠাৎ একটু চুপচাপ হয়ে যায়। অন্যরা বুঝতে পারেনি, কিন্তু ইশানের চোখে পড়ে।

ইশান নিচু স্বরে তৃষাকে জিজ্ঞেস করে,

"সব ঠিক আছে? মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছ।"

তৃষা হালকা হেসে বলে,

"কিছু না, এই তো ঠিক আছি।"

ইশান জানত, সব ঠিক নেই।

এদিকে নীরা আদ্রিতের একটু বেশি মজা করা নিয়ে বিরক্ত হচ্ছিল। আদ্রিত কি শুধুই মজা করতে ব্যস্ত, নাকি তার জন্য ভেতরে কোনো অনুভূতি লুকিয়ে রাখে? নীরার মনেও অনেক অজানা প্রশ্ন।


বন্ধুত্বে তিক্ততার সূচনা

আড্ডাটা ধীরে ধীরে জমে উঠছিল। পুরোনো গল্পগুলো সবাইকে স্মৃতির মাঝে ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেই হাসিখুশি মুহূর্তগুলোর মাঝে কোথাও যেন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল। ছোট ছোট ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে বড় কিছু হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

রাত্রি হতে শুরু করেছে। কফি আর স্ন্যাক্সের চাহিদা বাড়ছে। সায়ান হঠাৎ করে বলে ওঠে,

"তৃষা, এই ক্যাফেটার মালিক কি তোমার কোনো পুরোনো পরিচিত?"

তৃষা একটু অবাক হয়।

"না তো! এই জায়গাটা তো নতুন খোলা, জানি না এমন প্রশ্ন কেন করলে?"

সায়ান একটু মুচকি হেসে বলে,

"তৃষা, তুমি জানো আমি সবসময় মজা করি। এত সিরিয়াস হও কেন?"

কথা শুনে সবাই একটু হেসে ফেলে, কিন্তু তৃষার মনে একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। এদিকে সায়ান আবার রাহিকে টিপিক্যাল ফ্লার্টিং ভঙ্গিতে প্রশংসা করতে থাকে।

"রাহি, তুমি না প্রতি দিনই আরও সুন্দর হচ্ছ! তোমার এই গ্লো এর রহস্য কী?"

প্রাণের বন্ধু


রাহি হেসে বলে,

"আমার জীবনের রহস্য? এটা বোধহয় নেহালের কফি! সব ঠিক রাখার কাজ করে।"

তৃষা আর কিছু না বলে কফির মগ নিয়ে ক্যাফের ব্যালকনিতে চলে যায়। সে তার অনুভূতিগুলো গুছিয়ে নিতে চায়। ইশান সেটা লক্ষ্য করে এবং তার পেছনে আসে। ব্যালকনির এক কোণায় দাঁড়িয়ে ইশান বলে,

"তৃষা, তুই জানিস, গ্রুপে তুই সবসময় সেই বন্ধু ছিলিস যে সবার সমাধান দিত। আজ তুই চুপ। আসল কথা বলবি?"

তৃষা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলেই ফেলে,

"ইশান, তোর মনে হয় আমরা এখনো সেই স্কুলের বন্ধুদের মতো আছি? পাঁচ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। অনেক কিছু হারিয়েছি। আর এই বন্ধুত্বেও তেমন একটা শূন্যতা কাজ করছে।"

ইশান তৃষার দিকে তাকিয়ে বোঝে, সে আসল কথাটি বলছে না। কিন্তু এখন চাপ দিলে হয়তো বন্ধুত্বেই কোনো জট পাকাবে। তাই চুপ থাকে।

ভুল বোঝাবুঝির আঁচ

ভেতরের টেবিলে, নীরা আদ্রিতের সঙ্গে কথায় কথায় খোঁচা দিতে শুরু করে।

"তুই কি বুঝিস, তুই এমন হাসি ঠাট্টা ছাড়া আর কিছুই জানিস না। তোকে দেখে মনে হয় না, তুই কাউকে গুরুত্ব দিতে জানিস।"

আদ্রিত মুচকি হেসে বলে,

"তুই জানিস না, নীরা, আমি কেবল মজার জন্য আছি না। হয়তো আমার গুরুত্বটা তুই কখনো দেখিসনি।"

নীরার মুখে একটু ধাক্কা লাগে, কিন্তু সে গম্ভীর ভাবে বলে,

"তোর গুরুত্ব বোঝার সময় হয়তো আগেই চলে গেছে।"

এই কথোপকথনটা ইঙ্গিত দেয়, নীরার মনের ভেতর পুরোনো অভিমান জমে আছে।

প্রাণের বন্ধু


বন্ধুত্বের সম্পর্ক ধাক্কা খায়

রাতের খাবারের পর, পুরো গ্রুপটা হাঁটতে বের হয়। সবাই একত্র হলেও একধরনের বিভাজন স্পষ্ট ছিল। তৃষা এবং ইশান সামনের দিকে হাঁটছিল, রাহি এবং সায়ান মাঝখানে, আর নীরা এবং আদ্রিত পিছনে। এই দলটি যে মজার জন্য একত্রিত হয়েছে, তা বুঝতে আর বাকি নেই। কিন্তু তাদের ভেতরের জটিলতাগুলো ভাঙতে শুরু করেছে।

তৃষার মনে বারবার ভাবনা আসে, রাহি কি সত্যিই সায়ানের বেশি কাছের হয়ে গেছে? নীরা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে । আদ্রিত কি সত্যিই কখনো তাকে বুঝতে পেরেছে?

এভাবেই বন্ধুত্বের মধুর ভাঙন আর টানাপোড়েন একটা অদ্ভুত মোড় নিতে শুরু করে।

বন্ধুত্বের ফাটল

পরের দিন সকালের আলো ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই গ্রুপের চ্যাটে অস্বস্তি আর দুঃখের বার্তা ভেসে ওঠে। গতকালের আড্ডার ছাপ সবার মনে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু যা কেউ বুঝতে পারেনি, তা হলো—একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েই বিশাল ভুল বোঝাবুঝি জন্ম নিয়েছে।

সায়ানের অজানা খোঁচা

সকালে নীরার ফোন বেজে ওঠে। তৃষা কল করেছে।

“শুনলি সায়ান কি বলেছে?”

নীরা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল,

“না, কি হয়েছে আবার?”

তৃষা সায়ানের কথার একটা স্ক্রিনশট পাঠাল। সেখানে সায়ান আদ্রিতকে মেসেজে লিখেছে,

“তৃষা মনে হয় গ্রুপের সবার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ও হয়তো একা থাকতেই পছন্দ করে। আমি ভাবছি ওর সাথে কিছু সময় যোগাযোগ বন্ধ রাখব। সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেব, কিন্তু ও না থাকলে যেন মজা বেশি হয়।"

এই মেসেজ দেখে নীরা স্তম্ভিত হয়ে যায়।

“এটা কিভাবে বলতে পারে? তৃষা তো এত আড্ডা পছন্দ করে! ও তো নিজেই গতকাল গ্রুপটা চালানোর চেষ্টা করছিল।”

তৃষা বলল,

“আমি জানি না কেন সায়ান এমন বলল, কিন্তু ওকে এই নিয়ে কিছু বলব না। হয়তো সত্যিই ও আমাকে আর মেনে নিতে পারছে না।”

রাহির খোঁজ আর ঈর্ষা

অন্যদিকে রাহি সায়ানের থেকে একটু দূরত্বে থাকার চেষ্টা করছিল, কারণ গতকাল সায়ানের কিছু আচরণ ওকে একটু বিব্রত করেছিল। সায়ান তার ভালো বন্ধু, কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছিল, সায়ান কখনো কখনো সীমার বাইরে চলে যায়।

সায়ান বারবার রাহিকে ফোন করছিল, কিন্তু রাহি ফোন ধরছিল না। এটি সায়ানের মনে ক্ষোভ জন্মায়। সে ভাবে,

“রাহি হয়তো আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেন?”

প্রাণের বন্ধু

ইশানের পরামর্শ

তৃষা সেই দিন বিকেলে ইশানের সঙ্গে দেখা করল।

“তুই জানিস, গ্রুপটা ভাঙার পথে। আমি এভাবে দেখতে পারছি না।”

ইশান তৃষার কথা শুনে হাসে।

“গ্রুপটা ভাঙবে না। কিন্তু মাঝেমধ্যে দূরত্ব ভালো। সবাই একে অপরের উপর নির্ভর করে, কিন্তু নিজেদের জায়গাও দরকার। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তৃষা শান্ত হতে চেষ্টা করে, কিন্তু মনের মধ্যে সায়ানের কথাগুলো বারবার ফিরে আসে।


আদ্রিতের বুদ্ধি

অন্যদিকে আদ্রিত মেসেজ করে গ্রুপের সবাইকে ক্যাফেতে আরেকবার দেখা করার প্রস্তাব দেয়।

“যা-ই হয়ে থাকুক, আমরা একত্র হয়ে এটা সমাধান করব।”

নীরা প্রথমে আসতে চায়নি, কারণ তার মনে হচ্ছিল আদ্রিতকে দেখে তার পুরোনো অভিমান আবার জেগে উঠবে। কিন্তু ইশান এবং তৃষার কথায় সে শেষমেশ রাজি হয়।

একত্র হওয়া কিন্তু বিভাজন বজায় থাকা

ক্যাফেতে আবার সবাই জমা হয়। আদ্রিত আলাপ শুরু করার চেষ্টা করে, কিন্তু সবার মুখ ভার। তৃষা সবার থেকে একটু দূরে বসে, সায়ান একটু অস্বস্তিতে। রাহি তার চোখে সায়ানের জন্য একটা বিভ্রান্তি মিশ্রিত রাগ নিয়ে বসে আছে। ইশান এবং নীরা একমাত্র যাঁরা চেষ্টা করছিল সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে।

“তোমাদের কেউ কেউ যদি আড়ালে কথা না বলে খোলাখুলি বলতে, তবে হয়তো এমন পরিস্থিতি হতো না,” রাহি প্রথমেই বলে ফেলে।

সায়ান বুঝতে পারে কথাটা তার দিকে, কিন্তু সে সরাসরি কিছু বলে না। এভাবে অস্বস্তির পরিবেশ গাঢ় হতে থাকে।

হৃদয়ের দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমার সুযোগ

ক্যাফের পরিবেশ থমথমে। বন্ধুত্বের যে প্রাণবন্ত অনুভূতি একসময় এই গ্রুপকে একত্র করেছিল, তা যেন আজ ছায়ামাত্র। আড্ডা না জমার দায় কে নেবে, তা ঠিক করার আগে, সবার মনের দ্বন্দ্ব মুখ ফুটে বেরোতে শুরু করল।


সায়ানের খোলাসা

সবার সামনে এসে সায়ান বলে,

"তোমরা সবাই আমার সঙ্গে একটু রাগ করছো, তাই না? আমি কিছু কথা বলেছি যা ঠিক ছিল না। কিন্তু আমি নিজের দিকটা বলি?"

সবাই চুপ। তৃষা চোখ তুলে তাকাল, প্রথমবার সায়ানের কণ্ঠে এমন একটানা গম্ভীরতা।

"আমি অনুভব করি যে তৃষা এখন একটু দূরে চলে গেছে। সে নিজে উদ্যোগ নেয় ঠিকই, কিন্তু হয়তো সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কম স্বস্তি অনুভব করে। তাই আমি ভেবেছিলাম, একটু স্পেস দিলে হয়তো ব্যাপারটা সহজ হবে। কিন্তু হয়তো আমি এটা ভুলভাবে প্রকাশ করেছি।"

তৃষা ধীরে ধীরে বলে,

"আমার দূরত্ব কখনোই ইচ্ছাকৃত নয়। আমি তো বরং চেষ্টা করছিলাম সবাইকে একত্রে রাখা যায় কি না। আর এখন এটা শুনে মনে হচ্ছে, হয়তো আমার চেষ্টা তোমরা দেখতে পাচ্ছ না।"

নীরার প্রতিবাদ

এই সময় নীরা বলে উঠল,

"তৃষা একমাত্র নয়। আদ্রিতও কখনো নিজের কথাটা পরিষ্কার করে না। শুধু মজার আড়ালে সবকিছু ঢেকে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ওর মনে ঠিক কী চলছে, তা কেউ জানে না।"

প্রাণের বন্ধু

আদ্রিত মুচকি হেসে প্রতিক্রিয়া জানাল,

"সবাই যখন আড্ডা ছেড়ে অভিযোগের লাইনে চলে আসে, তখন মজা তো দিতে হয়, নাকি? তুই যদি সরাসরি জিজ্ঞেস করতিস, হয়তো আমিও বলতাম। কিন্তু তুই তো শুধু দূরত্ব রাখিস।"

নীরা হতবাক।

"তুই জানিস, তোর জন্যই হয়তো আমার এত দূরত্ব। কারণ তুই কখনো সেভাবে আমায় গুরুত্ব দিসনি।"

এই কথায় গ্রুপের সবাই চুপ হয়ে গেল। নীরার আবেগ এমন জোরালো যে তা কারও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। আদ্রিত এবার সোজা মুখে বলে,

"তোর মনে হয় আমি গুরুত্ব দিই না? তাহলে সত্যি বলতে আমার দোষ যে আমি সেটা প্রকাশ করতে পারিনি। আমি সব সময় ভেবেছি, তুই বুঝবি।"

রাহি আর সায়ানের ধোঁয়াশা

অন্যদিকে রাহি এবার একটু মুচকি হেসে বলে,

"তোমরা সবাই নিজের দোষগুলো মেনে নিচ্ছো দেখে ভালো লাগছে। তাহলে সায়ান, তোমার কি কিছু বলার নেই?"

সায়ান একটু চুপ। তারপর বলল,

"হ্যাঁ, আছে। রাহি, হয়তো আমি কিছু কথা বাড়াবাড়ি করেছিলাম। কিন্তু জানো, আমার মনে হয়েছিল তৃষার প্রতি আমার কিছু আচরণ তুমি মেনে নাওনি।"

রাহি অবাক হয়ে বলে,

"এটা কি তোমার কল্পনা, নাকি বাস্তব? সায়ান, আমি কোনো দিনই কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন কিছু করব না। তুই যা ভাবছিলি, তা কি আসলেই সত্য ছিল?"

ইশানের মিডিয়েটর রোল

ইশান এবার বলে উঠল,

"শোন, এখানে সবাই একটা কিছু লুকিয়ে রেখে সেই নিয়ে অযথা জট পাকিয়ে ফেলেছ। অথচ এই আড্ডায় আসার অর্থই ছিল অতীতের গণ্ডগোলগুলো ভুলে নতুন করে শুরু করা। সবাই যদি খোলাখুলি মনের কথা বলত, এতগুলো ভুল বোঝাবুঝি তো কখনো হতো না।"

ইশানের কথাগুলো যেন সবাইকে ধাক্কা দিল। সায়ান, তৃষা, নীরা, আদ্রিত, আর রাহি একে একে নিজেদের মনের গোপন দ্বিধা আর দুঃখ শেয়ার করল।


প্রাণের বন্ধু

ক্ষমার আলো

পরিস্থিতি এবার কিছুটা বদলাল। তৃষা সায়ানকে ক্ষমা করে তার ভুল বোঝাটা দূর করল। নীরা এবং আদ্রিতও নিজেদের অপার প্রকাশ্য আলোচনার পর একটা বোঝাপড়ায় এল। রাহি, সায়ানের প্রতি তার রাগ ভুলে তাদের বন্ধুত্বের গভীরতায় ফিরে যেতে চাইল।

ক্যাফের আলো মিটমিট করতে শুরু করেছিল, কিন্তু বন্ধুত্বের আলো যেন ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।

 বন্ধুত্বের পুনর্জন্ম ও নতুন সংকল্প

ক্যাফের আড্ডার মাঝে আবার এক ধরনের নতুন শান্তি ফিরে এসেছিল। যদিও একসময় মন অশান্ত ছিল, এখন যেন সেই অশান্তি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। ইশান, যিনি মাঝেমাঝে নিজের ক্ষুদ্র পরিসরে থেকেও এক ধরনের গভীর দৃষ্টি রেখেছেন, এবারে সকলে একে একে উঠে দাঁড়াল। যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীটাও একটুও ভারী মনে হয়নি। সবাই একে অপরের দিকে কিছুটা মুচকি হেসে তাকাল।

এতটুকু পারস্পরিক অভিযোগ, ক্ষমা ও সন্দেহের পর, তারা বুঝতে পারল—বন্ধুত্ব যতই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে, তবুও গভীর সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দ্যোতনা থাকে। তারা দেখতে পেল, কিভাবে আন্তরিকতা ও সাহসিকতা তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে দূর করতে সহায়তা করেছিল।

নতুন সিদ্ধান্তের জন্য তৈরি

রাহি গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করল,

"আজকে আমরা সবাই মনের কথা বলেছি। এটা শুধু একটা আলাপচারিতা ছিল না; এটা একটা নতুন সূচনা। আমি জানি, আমরা সবাই জীবনের নানা ঝামেলা ও দ্বন্দ্বে আছি, কিন্তু এটা আমাদের শেখায় যে, একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। আমাদের মধ্যে যে যা মনে ছিল, তা আজ স্পষ্ট হলো। আমি চেষ্ট করব, আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীর হবে এবং কখনো ছোটো ভুল-ভ্রান্তির জন্য যেন নতুন কোন ফাটল না আসে।"

আদ্রিত একে একে সবার দিকে তাকাল এবং বলল,

"আমাদের মধ্যে একটু দূরত্ব ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা আমাদেরকে নিজস্বতা ও উন্নতির দিকে ধাবিত করেছে। এখন আমরা সবাই অন্যদের থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমাদের যা আছে তা উপভোগ করতে এবং পরস্পরের প্রতি সম্মান ও যত্ন নেওয়া জরুরি।"

নীরা মুচকি হেসে আস্তে বলে,

"বিষয়গুলো সমাধান করতেই তো হচ্ছিল। অনেক কথা আমাদের মনে ছিল, কিন্তু ভাবলাম সবাই একটু ‘হালকা’ হলে ব্যাপারগুলো আরও সহজ হবে। আজ সেই চিন্তাভাবনা থেকেই সবার কথা শুনলাম। আমাদের সম্পর্ক এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তা সহজে ভাঙবে না।"

ভবিষ্যতের পথ

তৃষা যারপরনাই সিদ্ধান্তের শক্তিতে ফিরে বলল,

"হয়তো যেইভাবে আমাদের মধ্যে কিছু বিষয় ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, আগামী দিনে সেরকম কিছু যেন আর না হয়, তার জন্য আমাদের যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার, সে বিষয়ে যেন দৃঢ় হয়ে উঠি। ভবিষ্যতে আমরা সবদিক থেকেই একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি।"

ইশান হাসিমুখে যোগ করল,

"তবে হ্যাঁ, একটি নতুন জার্নি যেন শুরু হয় আমাদের সবার জন্য। তাই কেমন হয়, আমরা কিছু নতুন কর্মসূচী হাতে নিই, যা আমাদের একসাথে আরো শক্তিশালী করবে।"

এই আলোচনার সাথে সাথে, তারা সবাই একে অপরের হাত ধরল। অনুভুতি ছিল একটা শক্তিশালী বন্ধুত্বের তাগিদ, যেন এতদিন যে অজানা স্থানান্তর ছিল, তা আজ নতুন করে ফিরে এসেছে। তারা সবাই সেই আলোর মাঝে প্রবাহিত হলো, যেখানে অন্ধকার ও বিরোধীতার জায়গা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

প্রাণের বন্ধু

বন্ধুত্বের পরীক্ষার মুহূর্ত

একটি নতুন সূর্যোদয় হয়ে উঠছিল। সারা শহর যেন আরও এক ধাপ নতুন দিনের দিকে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু তাদের মাঝের সম্পর্ক এখন এক কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে। যে বন্ধুত্ব তারা পুনর্নির্মাণ করেছিল, সেটির গতি তারুণ্যের সতেজতার মতো ছিল। কিন্তু, বাস্তবতার কঠিন দিকগুলো কখনো তাদের পিছনে আসতে অপেক্ষা করছিল।


ক্যাফের সেই পুরনো টেবিলে আবার তারা বসে। একে একে একে দু'পা সবার আলোচনায় চোখ ফেলা যায়। একদিনের শান্তি যেন পরের দিনটা ভেঙে পড়তে পারে। কিছু ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নতুন পথ তৈরির জন্য, কিন্তু সেই পথ চিলেচাপলো গলি, যেখানে অভ্যস্ত পথচলা সহজ ছিল না।

সায়ান ও রাহির টানাপোড়েন

সায়ান একটা চাপ অনুভব করল। "বিশ্বস্ততা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে একসময় আমি ভুল ধারণা নিয়েছিলাম রাহি... তবে এটি একটি বড় পরীক্ষা," সায়ান মনে মনে ভাবছিল।

রাহি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সায়ানকে বলল, "তুমি ভুলই ভাবছিলে সায়ান। আমার পুরোনো কিছু বিশ্বাস আর ব্যর্থতার ফলে কথা না বলাই বরং সবার কাছে ভালো মনে হয়েছিল। এখন তুমি যদি পারো, আমাকে বল, ঐ ‘বিশ্বস্ততা’ আমিও তোমার মাঝেই খুঁজেছি।"

তবে এরপর চলতি কথা আপত্তিজনক হয়ে ওঠে। কয়েকটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি আগের সেতু ভেঙে দেয়।

আদ্রিত, নীরা ও তৃষার সিদ্ধান্ত

তবে নীরা ও আদ্রিতের সাথে ঘটল একটু ত্রুটি। অতীত গোপন বিষয়গুলো, ব্যক্তিগত ঝগড়ায় থেমে গিয়ে ফ্যালেও আটকে আসে।

তৃষা সম্মিলিত সবাই জানালে, "সব কিছু বুঝতে হবে তীক্ষ্ণ মনে, নির্লিপ্ত না হয়ে একে অপরের সঙ্গে শুদ্ধ মনোবল ভালো করার বিকল্প খুলুন – কাজটা সহজ নয়।"

যতসময় যায় তারা কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে, সত্যিই শেষ হয়, বন্ধুত্ব আজ দুরুদুর বুঝলাম

বন্ধুত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ

কিছুদিন পর, সায়ান, রাহি, নীরা, আদ্রিত, তৃষা এবং ইশান সবাই আবার সেই একই ক্যাফেতে বসে ছিল। আজ আর কোনও সংশয় ছিল না। তারা সকলেই নিজেদের ভুল বুঝতে শিখে আবার একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছে।

এই গল্পের চলমানতার মধ্যে, তারা বুঝতে পারল, কখনো কখনো সম্পর্কের উত্তরণের জন্য যেসব দুঃসময়ে ছিল, সেগুলো কেবল সম্পর্কের মুল প্রকৃতিকে আরও শক্তিশালী করার সহায়ক।

"বন্ধুত্ব অমর, কিন্তু সেই বন্ধুত্ব আসলেই জাঁকজমক ও অমিতাশায় থাকবে, যদি প্রত্যেকটি পরীক্ষার সমাধান না হয়।